সংসদীয় আসনের সীমানা নিয়ে ফের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলা। নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক খসড়া তালিকায় মেঘনাকে কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) আসনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব ঘিরে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে তীব্র মতবিভেদ।
দুদিনে পরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে একপক্ষের মতবিনিময় সভা ও অন্যপক্ষের সংবাদ সম্মেলন। একপক্ষে রয়েছে সাবেক বিএনপি নেতা ও একটি বলয়, অপরদিকে রয়েছেন বিএনপির বিভাগীয় নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় জনতার বড় অংশ।
গত শুক্রবার মেঘনা উপজেলার একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-মেঘনা) আসন পুনর্বহালের খসড়াকে স্বাগত জানান বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রমিজ উদ্দিন লন্ডনী ও তার অনুসারীরা। তারা বলেন, এ আসন থেকেই একাধিকবার এমপি হয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ‘তাকে পরাজিত করতে’ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ২০০৮ সালে আসনের সীমানা বদল করে। এখন নির্বাচন কমিশন সেই অবিচার কিছুটা হলেও সংশোধন করেছে বলে মন্তব্য করেন তারা।
রমিজ উদ্দিন বলেন, এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, আমাদের উন্নয়ন ও মর্যাদার সঙ্গেও জড়িত। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের ১০ আগস্ট গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত ধৈর্য ও সংহতির আহ্বান জানান।
কিন্তু পরদিন শনিবার মেঘনার মানিকারচর বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এই খসড়া বাতিলের দাবি তোলেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মো. আজহারুল হক শাহীন ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ভোটার সংখ্যা গুণে মেঘনাকে দাউদকান্দির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, অথচ বাস্তবতা, ইতিহাস ও জনচাহিদা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তাছাড়া হোমনা ও মেঘনা ছিল একটি আত্মিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক একতা। এটিকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থ হচ্ছে জনগণের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করা। তবে এই সিদ্ধান্ত বাতিল না হলে ৭ আগস্ট নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন এবং ১০ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করা হবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
গত দুইদিনে বাজারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মেঘনার অধিকাংশ মানুষই চান হোমনা-মেঘনা একসঙ্গে থেকে আগের কুমিল্লা-২ আসন বহাল থাকুক। একাধিক কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আমরা রিকশায় করেই হোমনা যেতে পারি। অথচ দাউদকান্দির সঙ্গে তো সরাসরি রাস্তাই নেই! যেতে হয় হোমনার সিনাই বা তিতাস হয়ে, না হয় গজারিয়ার ভাটেরচর দিয়ে ঘুরে।
তবে রাজনৈতিক সমীকরণটা একটু জটিল। বিএনপির অধিকাংশ দায়িত্বশীল নেতা হোমনা-মেঘনা চাইলেও রমিজ উদ্দিন ও তার অনুসারীরা দাউদকান্দি-মেঘনা চাইছেন। অনেকে অভিযোগ করছেন, তারা দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আমলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাংশ বলছে, ‘রমিজ সাহেব বহিষ্কৃত নেতা, এখন তার রাজনীতি বাঁচাতে মোশাররফ হোসেনকে আবার এমপি বানানোর কৌশল অবলম্বন করছে।’
অন্যদিকে অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধেও এসেছে নানা অভিযোগ। কেউ কেউ বলছেন, হোমনা-মেঘনা আসন বহাল থাকলে তার এমপি হওয়া সহজ হয়। আবার কেউ কেউ লিখেছেন, তিনি অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের মদদ দেন-এই নিয়ে এলাকায় ক্ষোভও রয়েছে। তবে এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে একমত পোষণ করে সাধারণ মানুষ নিজেদের আসন চায়।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৫৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেঘনা হোমনার অংশ হিসেবে কুমিল্লা-২ আসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯৮ সালে প্রশাসনিকভাবে মেঘনা আলাদা হলেও ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতায় হোমনা-মেঘনা একসঙ্গেই ছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে একটি মহলের চাপে মেঘনাকে কৃত্রিমভাবে দাউদকান্দির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অথচ সেখানে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ পর্যন্ত নেই। ২০২৩ সালের নির্বাচনে আবার হোমনা-মেঘনা একত্রে কুমিল্লা-২ আসন গঠন করে ভোটগ্রহণ করা হয়। তাই এখন হঠাৎ করে খসড়া পরিবর্তনে মানুষের মনে তৈরি হয়েছে শঙ্কা, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা।
১০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরই চূড়ান্ত হবে মেঘনার অবস্থান। তবে সেই অবস্থান কেবল মানচিত্রে নয়, বসে যাবে মানুষদের মনে। তাই এখানকার অনেকের প্রার্থনা এখন একটাই-ভোটের হিসাব নয়, জনগণের ইতিহাস যেন কেউ না ভুলে যায়।
কেকে/ এমএস