বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি বিভাগে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একাধিক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানান, এই বিভাগে একটি প্রভাবশালী চক্র বছরের পর বছর ধরে একের পর এক প্রকল্প ও অনুষ্ঠানে বাজেট জালিয়াতি, ভুয়া বিল তৈরি এবং আর্থিক অনিয়ম করে আসছে।
অভিযোগে উঠে এসেছে, সংগীত বিভাগের উপপরিচালক শামীমা জাহান ও তার স্বামী অন্তু গোলন্দাজের বিরুদ্ধে চলমান একটি ‘দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেট’ পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, আনিসুর রহমান নামের এক কর্মকর্তা—যিনি মূলত অন্য বিভাগের হলেও—তাকে পরিকল্পিতভাবে সংগীত বিভাগে রাখা হয়েছে অর্থ আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, ‘বারবার লিখিত ও মৌখিক অনুরোধের পরও আনিসুর রহমানকে মূল বিভাগে ফেরত পাঠানো হয়নি। সিন্ডিকেটের প্রভাব এতটাই যে প্রশাসনিক কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হচ্ছে না।’
সম্প্রতি নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাজেট সংক্রান্ত ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তথ্য অনুযায়ী, যেখানে কোনো সরাসরি সংগীত পরিবেশনা ছিল না, সেখানে ৭৫ হাজার টাকা বাজেট দেখানো হয়। তিনটি গান রেকর্ড করা হলেও বিল করা হয় পাঁচটি গানের। রেকর্ডিং স্টুডিওর প্রকৃত ভাড়া ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা হলেও দেখানো হয়েছে ৭ হাজার টাকা করে।
একইসাথে, ১৬ জন প্রকৃত শিল্পী অংশগ্রহণ করলেও ৮৬ জনের নামে ভুয়া লিপসিং শিল্পী দেখিয়ে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা হারে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার বিল তৈরি করা হয়। এছাড়া খাবারের বাজেটে জনপ্রতি ৫০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও দেওয়া হয় মাত্র ১২৫ টাকা। ৭৫ হাজার টাকা যন্ত্রশিল্পী সম্মানী দেয়া হয়েছে যেখানে কোন যন্ত্রশিল্পী ছিলই না।
অন্যদিকে, চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে আয়োজিত নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে চারটি দলের প্রত্যেকটির জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও তাদের দেওয়া হয় মাত্র ৫০ হাজার টাকা করে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর পরে কিছু টাকা ফেরত দেওয়া হলেও এটি দৃষ্টান্তমূলক অনিয়ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদন (জিও) ছাড়া বিদেশ সফর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, উপপরিচালক শামীমা জাহান ও তার স্বামী অন্তু গোলন্দাজের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চীন সফরকালে জিও না থাকায় বিষয়টি ধরা পড়লেও তারা প্রভাব খাটিয়ে দায় এড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
অপরদিকে, একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা শেখ এহসানুর রহমানের বিরুদ্ধেও দীর্ঘদিন ধরে নিয়ম বহির্ভুতভাবে চাকরি পালন ও অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলির আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে হেরে গিয়েও তিনি সেখানে যোগ না দিয়ে ঢাকাতেই অবৈধভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রভাব খাটিয়ে ৯২ লাখ টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করেছেন কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই।
অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছেন এক চুক্তিভিত্তিক পরিচালক (মেহজাবীন নোভা), যিনি নীতিনির্ধারণী পরামর্শদাতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে কাজ আদায় করেন। বলা হচ্ছে, এই সিন্ডিকেট একাডেমির নিয়মনীতি অমান্য করে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাট করছে।
শিল্পকলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তা ও সংস্কৃতি অঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তারা বলেন, ‘এই পবিত্র সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হতে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয় অর্থ ও জণগণের বিশ্বাস রক্ষার্থে কঠোর ব্যবস্থা এখন সময়ের দাবি।’
কেকে/এজে