সয়াবিন একটি বিস্ময়কর খাদ্যশস্য, যা মানবদেহ ও প্রাণী উভয়ের জন্য উচ্চমানের প্রোটিনের নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী উৎস। প্রাণী খাদ্যে ব্যবহৃত সয়াবিন মিল পোলট্রি ও গবাদিপশুর পুষ্টি, বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত কার্যকর। দেশীয় প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান ডিম ও মুরগির চাহিদা পূরণে সয়াবিন মিলের গুরুত্ব আগামী দিনগুলোতে আরো বাড়বে।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উদযাপিত হলো ‘সয় মাস ২০২৫’। মঙ্গলবার ঢাকার বসুন্ধরায় অবস্থিত বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন মত দেন অংশগ্রহণকারীরা। বিপিআইসিসি এবং ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) যৌথভাবে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় পোলট্রি ও ফিড শিল্প সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। বক্তারা সয়াবিনভিত্তিক শিল্পের ভবিষ্যৎ, আমদানি নির্ভরতা, স্থানীয় উৎপাদনের সম্ভাবনা ও পুষ্টি নিরাপত্তায় এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
বিপিআইসিসির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, সয়াবিন বিশেষ করে সয়াবিন মিল হলো প্রাণী খাদ্যে ব্যবহৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি গবাদিপশু ও পোলট্রির বৃদ্ধি, মাংসপেশি গঠন ও সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এতে বিদ্যমান লাইসিন, ট্রিপটোফান, থ্রিওনিন ও আইসোলিউসিনসহ প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিডের সুষম সমন্বয় রয়েছে, যা সাধারণত শস্যে পাওয়া যায় না। সয়াবিন মিল সহজে হজমযোগ্য এবং প্রাণীর জন্য রুচিকর হওয়ায় খাদ্যে মিশ্রিত করলে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে। খরচের দিক থেকেও মাছের গুঁড়ার তুলনায় সয়াবিন মিল অধিক সাশ্রয়ী।
বিশ্ব পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ডাব্লিউপিএসএ-বিবি) সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, দেশে প্রতিবছর ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন সয়াবিন মিলের চাহিদা রয়েছে। যদিও দেশীয় সয়াবিন উৎপাদন অত্যন্ত সীমিত, আমরা স্থানীয়ভাবে ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে মোট চাহিদার প্রায় ৬০-৭৫ শতাংশ সয়াবিন মিল সংগ্রহ করি।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) মহাসচিব মো. নাজরুল ইসলাম বলেন, সয়াবিন বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি মানবদেহে সরাসরি এবং প্রাণী খাদ্যের মাধ্যমে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ডিম ও মুরগির খাওয়ার হার দ্বিগুণ হতে পারে। ফলে প্রাণী খাদ্য উৎপাদনও বাড়াতে হবে, যা সরাসরি সয়াবিন মিলের চাহিদা বাড়াবে।
সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসান এক বার্তায় বলেন, সয়াবিন একটি ‘মিরাকল বিন’। এতে নয়টি অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, যা মানবদেহে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয় না। তাই এটি প্রাণীজ প্রোটিনের একটি কার্যকর বিকল্প। তিনি জানান, সিটি গ্রুপ আমেরিকা থেকে সয়াবিন আমদানি করে এবং তেল উৎপাদনের পাশাপাশি সয়াবিন মিলও উৎপাদন করে থাকে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক তানজিমা মোস্তফা বলেন, সয়াবিন একটি অনন্য প্রোটিনের উৎস; যা মানব ও প্রাণী উভয়ের পুষ্টি জোগাতে সহায়ক। সয়াবিন মিল প্রাণী খাদ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রোটিন উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি প্রাণীর পুষ্টি শোষণের হারও বাড়িয়ে দেয়।
তিনি জানান, মেঘনা গ্রুপের ‘ফ্রেশ’ ব্র্যান্ডের অধীনে জানুয়ারি ২০২৫ মাসে ৪৮ হাজার টন সয়াবিন তেল এবং ৬৮ হাজার টন সয়াবিন মিল সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও কানাডা থেকে সয়াবিন সংগ্রহ করে এবং দুটি বড় ক্রাশিং মিলের মাধ্যমে প্রতিদিন ৭,৫০০ টন সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম।
তানজিমা মোস্তফা বলেন, বাংলাদেশে প্রোটিন-এনার্জি অপুষ্টির হার এখনো বিশ্ব গড়ের চেয়ে বেশি। এমন বাস্তবতায় ‘সয় মাস’-এর মতো সচেতনতা মূলক উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
ইউএসএসইসি’র বাংলাদেশ টিম লিডার খবিবুর রহমান কঞ্চন বলেন, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৩৯৭ থেকে ৩৯৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করে ১১৩ থেকে ১১৮.৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ২৮-৩০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন উচ্চমানের প্রোটিন ও তেল সমন্বয়ে গঠিত, নিরাপদ ও টেকসই হওয়ায় বিশ্বের ক্রেতারা তা পছন্দ করে।
তিনি জানান, ইউএসএসইসি বিশ্বব্যাপী ‘সয় মাস’ উদযাপনের পথিকৃৎ। সংগঠনটি ‘ রাইট টু প্রটিন’ উদ্যোগের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে বিপিআইসিসির সঙ্গে মিলে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এফআইএবি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. আহসানুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক শাহ ফাহাদ হাবিব, ভাইস-প্রেসিডেন্ট মো. আনোয়ারুল হক এবং ডব্লিউপিএসএ-বিবির কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান।
কেকে/ এমএস