ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বীরকন্যা কাকন বিবি

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৩:১৫ অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০২১

বীরকন্যা কাকন বিবি

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অনেক নারীর বীরত্বগাথা আমাদের এখনও অজানা। পাকসেনাদের বিরুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও রণাঙ্গনে বীরদর্পে যুদ্ধ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রকৃত চিত্র বিজয়ের ৫০ বছরেও ফুটে ওঠেনি। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই না পাওয়া এমনই একজন সংগ্রামী নারীর নাম কাকন বিবি। মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিকন্যা কাকন বিবি খাসিয়া সম্প্রদায়ের এক সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার বীরত্বগাথা নিয়ে লিখেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

জন্ম ও শৈশব
কাকন বিবি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের মিজোরাম প্রদেশে এক খাসিয়া পরিবারে। তবে তার জন্ম তারিখ সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তার বাবা গিসয়। তিনি জুমচাষের সঙ্গে আজীবন জড়িত ছিলেন। মা মেলি। তিনি স্বামীকে জুমচাষে সহযোগিতা করতেন এবং গৃহ সামলাতেন। গিসয়-মেলি দম্পতির ছিল তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে উহর, মেঝো ছেলে উসাল, ছো ছেলে উফান। আর বড় মেয়ে কাফল, সবার ছো মেয়ে কাতেক নিয়তা বা কাকন বিবি। তাদের পরিবারটি ছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। কাকন বিবির বয়স যখন ছয় মাস তখন এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে তার বাবা গিসয় মৃত্যুবরণ করেন। বাবার মৃত্যুর ছয় মাসের মাথায় চিরবিদায় নেন মা মেলিও। অভাবের সংসারে পাঁচটি এতিম সন্তান একেবারেই অসহায় হয়ে পড়ে তখন। গিসয়ের জমি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ফলে অল্প বয়সি ভাইদের উপার্জনের জন্য কাজে লাগতে হয়। তাদের আর খুব বেশি পড়াশুনা করা সম্ভব হয়নি। তবে খাসিয়ারা যেহেতু একটি গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন করে সেহেতু প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তখন পরিবারটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। গিসয়ের অন্য ভাইবোনদের অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না যে তারা এতিম সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবে। কাকন বিবিদের গ্রাম ছিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুবই কাছে। গ্রামের নাম নক্রাই। সেটি চেলা বাজার থেকে মাইল ছয়েকের পথ। কাকন বিবির ভাইদের পরিবার এখনও সেখানেই থাকে।

কাকন বিবির বয়স যখন ৮-৯ মাস তখনই তার বড় বোন কাফলের বিয়ে হয়ে যায় এক বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে। তার নাম খুশি কমান্ডার। মূলত তিনি ব্রিটিশ আমলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে চাকরি করতেন। এ কারণেই লোকে তাকে কমান্ডার বলত। খুশি কমান্ডারের বাড়ি ছিল সিলেট জেলার কাঁঠালবাড়ি গ্রামে। খুশি কমান্ডার কাফলকে বিয়ে করার পর নিজের গ্রামেই ফিরে আসেন। তাদের বেশ জমিজমা ছিল। স্থানীয়ভাবে তারা ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন।

মা মারা যাওয়ার পর দুগ্ধ শিশু কাকন বিবিকে দেখাশোনা করতেন তার বড় বোন কাফল। কিন্তু তার বিয়ের পর কাকন বিবিকে দেখাশোনা করার আর কেউ রইল না। অবশেষে কাফলই তার স্বামীর সহযোগিতায় কাকন বিবিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে সন্তানের মতো মানুষ করতে থাকেন। খুশি কমান্ডার ছিলেন গোড়ামিমুক্ত একজন উদার প্রকৃতির মানুষ। খুশি কমান্ডারের গৃহস্থ পরিবারেই কাকন বিবির বেড়ে উঠা। মা বলতে তিনি বোঝেন বড় বোন কাফলকে আর বাবা বলতে বোঝেন খুশি কমান্ডারকে। খুশি কমান্ডারের পরিবারের অন্য সদস্যরা এতিম এই শিশুটিকে অপাত্য স্নেহেই বড় করে তোলেন। কাকন বিবি তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর এদেশকেই নিজের দেশ বলে জেনে এসেছেন।

যুদ্ধদিনের স্মৃতি
সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলটি ছিল পাঁচ নম্বর সেক্টরের অধীন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল মীর শওকত আলী। কাকন বিবি যে গ্রামে থাকতেন তার পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আবার এই ক্যাম্প থেকে খানিকটা দূরেই ছিল পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। যা স্থানীয়ভাবে টেংরা ক্যাম্প নামে পরিচিত। মুক্তিবাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল তার কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন শহীদ মিয়া। মীর শওকত আলী একদিন ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। তিনিই মূলত কাকন বিবিকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহের কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহিত করেন। কাকন বিবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি তাকে কাজের গুরুত্বও বুঝিয়ে বলেন। কাকন বিবির স্বামী যেহেতু আগে পাকিস্তানি ক্যাম্পে কাজ করতেন সুতরাং তার পক্ষেই সম্ভব সেখানকার খবর এনে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রেরণ করা। কাকন বিবিও উৎসাহ নিয়ে দেশের জন্য কিছু একটা করতে পারবেন এই ভেবে রাজি হয়ে যান।

ইতিমধ্যে তার ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডারকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে ফেলে। পিতার মতো স্নেহ দিয়ে যে লোকটি তাকে বড় করে তুলেছিল, যে ছিল তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী, সেই খুশি কমান্ডারকে একদিন পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ভারত থেকে যেসব মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশে আসে তাদের তিনি সহযোগিতা করেন। স্থানীয় রাজাকাররাই পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে এ তথ্য জানায়। খুশী কমান্ডারকে পরে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। এ ঘটনায় কাকন বিবি খুবই কষ্ট পান। প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন। নিজের জীবনকেও তখন তার কাছে একেবারে তুচ্ছ মনে হয়। তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা যায়, কীভাবে এদেশ থেকে পাকহানাদার বাহিনীকে হটানো যায়।

কাকন বিবি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন একজন ‘ইনফরমার’ হিসাবে। যার কাজ ছিল পাকিস্তানি ক্যাম্পে ঢুকে তাদের হাতিয়ারের ধরন, সংখ্যা ও সৈনিকদের অবস্থান সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করা। স্বামী শাহেদ আলী তার এই কাজে বাধা দিলেও তিনি তা উপেক্ষা করেন। সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করার জন্য তিনি কয়েক দিন সময় নেন। চিন্তা করেন। পরে নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে একটি ময়লা ও ছেঁড়া কাপড় পরে একদিন দিনের বেলায় ভিক্ষা করতে করতে রওনা দেন টেংরা ক্যাম্পের দিকে। এলাকার লোকজনদের অনেকেই তখন শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গেছে। ফলে তাকে খুব বেশি কেউ চিনতেও পারল না। প্রথমে টেংরা ক্যাম্পের বাইরে কয়েকটি বাড়িতে ভিক্ষা করেন। পরে কৌশলে এক সময় ঢুকে পড়েন টেংরা ক্যাম্পের ভিতর। ভিক্ষা চান পাকিস্তানি মিলিটারিদের কাছেই। তারা কিছু ময়দা ও আটা ভিক্ষা দেয়। ভিক্ষা করার পাশাপাশি মিলিটারিদের কাছে তার প্রথম স্বামী আব্দুল মজিদ খানের খোঁজও করেন। নানা কায়দায় কিছুক্ষণ ক্যাম্পের ভেতর অবস্থান করে সবকিছু দেখার চেষ্টা করেন এবং প্রথম দিন তিনি খুব ভালোভাবেই তার দায়িত্ব পালন করেন। টেংরা ক্যাম্পে তিনি যা দেখেছেন তা সবই এসে জানান কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়াকে। মুক্তিবাহিনী তখন সেই মোতাবেক তাদের অপারেশন চালায় এবং এতে তারা সফলও হয়।

দ্বিতীয় দিনও কাকন বিবি একই কায়দায় টেংরা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। তখন ক্যাম্পের একটি ঘরে কয়েকজন মেয়েকেও দেখতে পান। মেয়েরা ছিল ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত। কাকন বিবির বুঝতে বাকি থাকল না এদেরকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে এবং শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিন তিনি যখন মিলিটারির কাছে তার স্বামীর খবর জানতে চান তখনই তাকে আটক করে ফেলা হয়। কয়েকজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মিলে চালায় শারীরিক নির্যাতন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কাকন বিবি যে একজন ‘ইনফরমার’ এটা তারা ভাবতে পারেনি। নির্যাতন শেষে তারা কাকন বিবিকে ছেড়ে দেয়। অত্যাচারের মুখেও কাকন বিবি ঠিকই সেদিন সমস্ত তথ্য এনে কোম্পানি কমান্ডারকে জানান। তিনি কমান্ডারকে বুঝতে দেননি তার উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পশুরা।

এ ঘটনার পর অবশ্য কাকন বিবি বেশ কিছুদিন আর টেংরা ক্যাম্পে যাননি। টেংরা ক্যাম্পে ‘ইনফরমার’ হিসাবে কাজ করেছেন কাকন বিবি, এ খবর জানামাত্রই দ্বিতীয় স্বামী শাহেদ আলী রেগে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি তাকে প্রচ- মারধর করলেন। একপর্যায়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ‘নষ্টা মেয়ে’ বলে। একমাত্র মেয়ে সখিনা বিবিকে শাহেদ আলী নিজের কাছেই রেখে দিলেন। কাকন বিবি এখন একেবারেই গৃহহীন, সহায়-সম্বলহীন। কোথাও যাওয়ার তার কোনো জায়গা রইল না। দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে গেল তার সংসার। শাহেদ আলী যুদ্ধের বাজারেই আবার বিয়ে করলেন।

এই দুঃসময়েও কাকন বিবি ‘ইনফরমার’ হিসেবে কাজ করার জন্য যান সুনামগঞ্জে অবস্থিত পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে যান সিলেট ক্যাম্পে। পরে যান গোবিন্দগঞ্জ, জাউয়া বাজার ক্যাম্পে। সব জায়গাতেই তার একই কাজ। ক্যাম্পের অবস্থান, সৈন্য সংখ্যা, হাতিয়ার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আসা। যেতেন সেই ভিক্ষুকের বেশেই। পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে খোঁজ করতেন নিজের প্রথম স্বামীর। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে কে রাখে কার খবর! বরং পাকিস্তানি সৈন্যরা কাকন বিবিকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতনই চালাত। এতকিছুর পরেও কাকন বিবি কিন্তু নিজের কাজ সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ মাত্রায় সচেতন। কারণ তার দেওয়া তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনে জয়ের ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করত। এভাবে অবশ্য তিনি আরও দুই-তিনটি ক্যাম্পে যান।

বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে কাজ শেষ করে কাকন বিবি আবার নিজের গ্রাম কাঁঠালবাড়িতেই ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পর কোম্পানি কমান্ডার শহিদ মিয়ার নির্দেশে তৃতীয়বারের মতো তিনি আবার যান টেংরা ক্যাম্পে। তৃতীয়বারও নানা নির্যাতনের মুখে পড়েন। টেংরা ক্যাম্পে তখন আরও অনেক বাঙালি মেয়েকেই বন্দি করে রেখেছে পাক হানাদার বাহিনী। কাকন বিবি ক্যাম্প থেকে খবর সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রেরণ করছেন, এ নিয়ে স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার সন্দেহ করে। তবে তারা এ ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত ছিল না। তবু ওইসব রাজাকাররা পাকিস্তানি ক্যাম্পে গিয়ে অফিসারদের কাছে তাদের সেই সন্দেহের কথা জানায়। তার ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডার যে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিল এবং তাকে যে এ কারণে হত্যা করা হয়েছে সে কথাও জানায়।

এরপর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। কাকন বিবিকে নির্যাতনের একপর্যায়ে পাকবাহিনীর বড় অফিসার এল সেখানে, সে এসে দেখে কাকন বিবি অজ্ঞান। অফিসার ডাক্তার ডাকালেন। ডাক্তার এসে ইনজেকশান দিয়ে কাকন বিবির জ্ঞান ফেরাল। তারপর তাকে কিছু খাবারও দেওয়া হলো। কিন্তু কাকন বিবির আর খাওয়ার মত সামর্থও ছিল না। উরুতে যে গরম লোহার শিক ঢোকানো হয়েছে তার যন্ত্রণায় তিনি সবকিছু অন্ধকার দেখছেন। এর মধ্যেই অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন ক্যাম্পে যাও?’ কাকন বিবি অস্ফুট স্বরে উত্তর দিলেন, ‘স্বামীর খোঁজে।’ অফিসার আবার জিজ্ঞেস করল, কে তোমার স্বামী?’ কাকন বিবি বললেন, আব্দুল মজিদ খান।’ অফিসার বলল, সে কোথায় থাকে?’ কাকন বিবি বললেন, ‘সিলেটে।’ ব্যস, এটুকুই। আর কিছু বলতে পারেননি কাকন বিবি। আবার তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অফিসার তখন ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে সিলেটে ওয়ারলেস করল। সেখানে সত্যিকার অর্থেই আব্দুল মজিদ খান নামে কোনো সৈনিক আছে কি না তা জানার জন্য। আব্দুল মজিদ খান তখন সিলেটেই ছিলেন। কিন্তু তিনি ক্যাম্পের বাইরে ছিলেন।

মজিদ খান ক্যাম্পে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে অফিসার তার সঙ্গে কথা বলে। অফিসার মজিদ খানের কাছে জানতে চায়, কাঁঠালবাড়িতে তার কোনো স্ত্রী আছে কি না? মজিদ খান জানালো যে, কাকন বিবি নামে তার স্ত্রী কাঁঠালবাড়িতে থাকে এবং সে খাসিয়া উপজাতি।

অফিসার মজিদ খানের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়ার পর কাকন বিবিকে পাক হানাদাররা আর কোনো অত্যাচার করেনি এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দিলেও কাকন বিবির অবস্থা তখন সঙ্গীন। তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তাকে নেওয়ারও কেউ নেই।

তিনি রাস্তাতেই এই অসুস্থ শরীর নিয়ে পড়ে রইলেন। পরে অবশ্য লোকজন তাকে ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তবে তার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা না হলেও এই মজিদ খানের কারণেই কাকন বিবি সেবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন।

গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়েই একনাগাড়ে সাত দিন পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারেরা তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লোহার রড গরম করে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছেঁকা দেওয়া হয়। সুস্থ হয়ে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন বাংলাবাজারে। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষিত হন মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে।

এর পরবর্তীকালে তিনি সম্মুখ যুদ্ধ আর গুপ্তচর উভয় কাজই শুরু করেন। এরপরে প্রায় ২০টি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। এই যুদ্ধে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

ব্যক্তিগত জীবন
কাকন বিবি ছিলেন নিরক্ষর। স্কুল কী জিনিস তা তার বাল্যকালে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। খুশি কমান্ডারের পরিবারেই তিনি নানা কাজকর্ম করতেন। তবে সেটা বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু কোনো কাজ ছিল না বলেই তিনি পরিবারের অন্য মহিলাদের নানা কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এভাবেই প্রায় ত্রিশ বছর কাকন বিবির এ পরিবারে কাটে। পাকিস্তান আমলে মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি বিবাহযোগ্য মেয়ের জন্য এই বয়স অনেক বেশি। কাঁঠালবাগান গ্রামটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে। গ্রাম থেকে একটু দূরেই ছিল পাকিস্তান সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে সৈনিক হিসাবে কাজ করতেন পাঞ্জাব প্রদেশের আব্দুল মজিদ খান। দেখতে বেশ লম্বা-চওড়া। খুশি কমান্ডারের সঙ্গে মজিদ খানের বেশ চেনাজানা ছিল, বাড়িতেও আসতেন মাঝেমধ্যে। খুশি কমান্ডারই এক সময় আবদুল মজিদ খানের সঙ্গে কাকন বিবির বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করেন। পারিবারিকভাবেই সে বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের সাল বা তারিখ সঠিকভাবে জানা না গেলেও ১৯৫৮-৫৯ সাল হতে পারে।

বিয়ে হওয়ার পর কাকন বিবি ভগ্নিপতির বাড়ি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থল বোগলা ক্যাম্পে এসে ওঠেন। সেখানেই নতুন করে সংসার শুরু করেন। বোগলা ক্যাম্পে তিনি প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন। আব্দুল মজিদ খান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বদলিও হতেন। কাকন বিবিকেও তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন তখন। সে সময় কাকন বিবি সুনামগঞ্জে প্রায় ছয় মাস, সিলেটে প্রায় সাত মাস এবং ছাতকেও কিছুদিন স্বামীর সঙ্গে কাটান। বিবাহিত জীবনের দীর্ঘ আট বছরে তাদের ঘরে তিনটি সন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু জন্মের পরপরই তারা মৃত্যুবরণ করে। খুব সম্ভবত এ কারণেই আব্দুল মজিদ খান সিলেট আকালিয়া ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় কাকন বিবিকে পরিত্যাগ করেন। হঠাৎ করেই আব্দুল মজিদ খান উধাও হয়ে যান। কাকন বিবি একা হয়ে পড়েন। স্বামীর খোঁজে তিনি ক্যাম্পের অন্যান্য সৈনিকদের কাছে অভিযোগ করেন, অফিসে গিয়েও নালিশ করেন। কিন্তু সকলেই তাকে অসহযোগিতা করে। শেষ পর্যন্ত স্বামীর কোনো খোঁজখবর করতে না পেরে কাকন বিবি আবার তার ভগ্নিপতি ও বোনের সংসারে ফিরে আসেন। এরপর আর কোনোদিন আব্দুল মজিদ খানের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। মজিদ খানও তার কোনো খোঁজখবর নেননি। তবে তার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা না হলেও এই মজিদ খানের কারণেই কাকন বিবি একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন।

স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে পুনরায় কাঁঠালবাড়িতে ফিরে আসায় পরিবারের অনেকেই মনক্ষুণœ হন। বিচলিত হন ভগ্নিপতি খুশি কমান্ডারও। কিন্তু তিনি যেহেতু কাকন বিবিকে তার অন্য চার সন্তানের মতোই বড় করে তুলেছেন সে কারণে খুব বেশি ক্ষুব্ধও হতে পারলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন আবার তাকে বিয়ে দেওয়া যায় কি না। এই অবস্থায় কাকন বিবি প্রায় বছর দেড়েক ভগ্নিপতির সংসারেই থাকলেন। শেষ পর্যন্ত খুশি কমান্ডারই প্রতিবেশী শাহেদ আলীর সঙ্গে কাকন বিবির পুনরায় বিয়ে দেন। শাহেদ আলী ছিলেন ছোখাটো কৃষক। তার আগেও সংসার ছিল কিন্তু সেই সংসারে কোনো সন্তান ছিল না। মূলত সন্তানের আশাতেই তিনি কাকন বিবিকে বিয়ে করেন। শাহেদ আলীর সঙ্গে কাকন বিবির সংসার টিকেছিল দুই বছর। এরমধ্যেই কাকন বিবির গর্ভে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। নাম সখিনা বিবি।

শেষ জীবন
দেশ স্বাধীন হলে কাকন বিবি দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে এক ব্যক্তির কুঁড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনাসহ আশ্রয় নেন। এরপর প্রায় দুই যুগ তিনি ছিলেন সবার চোখের অন্তরালে। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় সাংবাদিক বিষয়টি সকলের গোচরে নিয়ে আসলে দেশব্যাপী এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে এক একর খাস জমি প্রদান করেন। সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাকে ওই জায়গার ওপরে একটি ছোট কুঁড়েঘর নির্মাণ করে দেন। এরপরের কয়েক বছর মোটামুটি ভালো কাটলেও পরবর্তীকালে অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। ব্রেন স্ট্রোক করে ২০১৭ সালের ২১ জুলাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কাকন বিবি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ২১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

 
Electronic Paper