পঞ্চগড়ের সামগ্রিক উন্নয়ন, জনসেবা নিশ্চিতকরণ, স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠা ও পর্যটনে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের মাধ্যমে জেলার মানুষের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নেওয়া জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছেন। বদলি জনিত কারণে রোববার (১৬ নভেম্বর) বিকালে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
সম্প্রতি তিনি পদোন্নতি পেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগদানের নির্দেশনা পেয়েছেন।
জানা যায়, পঞ্চগড়ে দীর্ঘদিন ধরে বিনোদন সুবিধা, প্রশাসনিক সেবা ও উন্নয়ন কাঠামোর ঘাটতি ছিল প্রকট। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সাবেত আলী শুধু একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেই কাজ করেননি; বরং নিজস্ব উদ্যোগ, দূরদৃষ্টি ও আন্তরিকতা দিয়ে জেলার উন্নয়নে যুক্ত হন একজন পরিকল্পনাকারীর মতো। তার উৎসাহে মিরগড় এলাকায় গড়ে ওঠে জেলা প্রশাসন ইকোপার্ক। যা বর্তমানে পঞ্চগড়ের নতুন পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এ ছাড়া পঞ্চগড় অত্যাধুনিক ওয়াচ টাওয়ার শিগগিরই পর্যটকদের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা ও সীমান্তবর্তী ভারতের অপরূপ দৃশ্য দেখার নতুন জানালা খুলে দেবে।
তার দায়িত্বকালেই বাংলাবান্ধায় দেশের সর্বোচ্চ উচ্চতায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাস্তবায়িত হয়েছে। জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার করতে তিনি উদ্যোগ নেন একটি উন্নতমানের অডিটোরিয়াম নির্মাণে। তেঁতুলিয়ায় নতুন পুলিশ ফাঁড়ির জন্য নিমার্ণের অনুমোদন নিয়ে আসেন৷ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নিতে তিনি ভূমিকা রাখেন। মিরগড়ের কাঠের সেতু উন্নয়নসহ বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, প্রশাসনিক সেবায় তিনি গড়ে তোলেন অনুকরণীয় উদাহরণ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সর্বদা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত রাখেন তিনি। সপ্তাহের প্রতি বুধবার তিনি সরাসরি মানুষের অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। যা স্থানীয়দের আস্থাকে নতুনভাবে শক্তিশালী করেছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তিনি নিজ হাতে মনিটরিং করে গেছেন । সরকারি দপ্তরগুলোতে অনিয়ম ও হয়রানি কমাতে গঠন করেন বিশেষ মনিটরিং সেল, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে বড় ভূমিকা রাখে।
এদিকে পঞ্চগড়ের চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং ক্ষুদ্র চা চাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে তিনি মাঠপর্যায়ে নিয়মিত তদারকি করে গেছেন। তার প্রচেষ্টায় চায়ের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হওয়ায় উপকৃত হয়েছেন হাজারো কৃষক। একই সঙ্গে জেলার ভূমি সেবা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে এক রুমেই সব ভূমি সম্পর্কিত কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে তিনি সেবা সহজতর করেন। তার আমলে পঞ্চগড় অর্জন করে শতভাগ জন্মনিবন্ধনের সফলতা।
বিদায়বেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও তার বাসভবনে ছিল মানুষের ঢল। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সুধীজন, চা চাষি, কৃষক, দিনমজুর সবাই ছুটে আসেন তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। অনেকে নীরব চোখের অশ্রু ফেলেছেন তার বিদায়ে৷
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাকে নিয়ে আবেগঘন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন অনেকে। জেলা ছাড়ার মুহূর্তে মানুষের চোখে ছিল অশ্রু, মুখে কৃতজ্ঞতা একজন প্রশাসকের প্রতি যে ভালোবাসা সাধারণ মানুষের মনে তৈরি হতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ দেখিয়েছে পঞ্চগড়।
স্থানীয়রা বলেন, ‘সাবেত আলীর মতো সৎ, কর্মঠ ও মানবিক জেলা প্রশাসক এই জেলায় আর পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা আছে। তার বিদায়কে পঞ্চগড়বাসী এক বড় ক্ষতি হিসেবে দেখছেন।’
তারা আশা করছেন, দেশের যেখানেই তিনি দায়িত্ব পালন করুন না কেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবেন একই আন্তরিকতায়।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় চা বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মানিক খান বলেন, ‘পঞ্চগড়ে চাষিরা বর্তমানে চা পাতার নায্য দাম পাচ্ছে৷ আর এটি নিশ্চিত ও সম্ভব করেছেন সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক সাবেত আলী৷’
নর্থবাংলা ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজমের পরিচালক আহসান হাবীব বলেন, ‘বিদায়ী জেলা প্রশাসক সাবেত আলী পঞ্চগড়ে বিনোদনের জন্য ইকোপার্কসহ পর্যটন খাতে ব্যাপক উন্নয়ন দেখিয়ে গেলেন৷ এমন জেলা প্রশাসক যদি সব জেলায় থাকতো তাহলে আরও এগিয়ে যেতো দেশ৷’
সাবেত আলী বলেন, ‘এই জেলায় এক বছর দুই মাস কর্মকাল শেষে পঞ্চগড় জেলা ছেড়ে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো৷ ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যোগদানের সময় আপনারা আমাকে যেভাবে ফুল দিয়ে বরণ করেছিলেন, বিদায় বেলায় ঠিক একইভাবে আপনাদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পঞ্চগড় ছেড়ে চলে যাচ্ছি...আলহামদুলিল্লাহ।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৪ মাসে এ জেলায় আপনাদের সবার সহযোগিতায় যে উন্নয়নমূলক কাজগুলো করা হয়েছে, সেগুলো দেখাশোনার দায়িত্ব আপনাদের উপরেই রেখে গেলাম। আমার এই স্বল্প সময়ের কর্মকালে আপনাদের সহযোগিতার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, আপনাদের এই সহযোগিতা পরবর্তী জেলা প্রশাসকের জন্যও অব্যাহত থাকবে।’
কেকে/এমএ