কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর বালুর বিশাল রাজ্য যেন গনিমতের মাল। কোটি কোটি টাকার এই বালু লুটেপুটে খেলেও দেখার কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের মৌখিক নির্দেশনায় এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
রোববার (১৬ নভেম্বর) বালুর ট্রলার থেকে জেলা প্রশাসনের খাস আদায়ের টাকা তুলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সম্পাদক ও সদর উপজেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আবেদুর রহমান আন্নু। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌখিক নির্দেশনা বা খাস আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।
এদিকে, এই বালু উত্তোলন বন্ধে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটি) পক্ষ থেকে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দেওয়া হলেও অবৈধ চক্রের কর্মকাণ্ড চলছে অবাধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাইকোর্টে রিটের অজুহাতে একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত ১৭-১৮ বছর ধরে কুষ্টিয়া পাবনার নাটোর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পদ্মা নদী থেকে শত শত কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই চক্রটি স্থানীয় প্রশাসন পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এই অপকর্ম চালিয়ে এসেছে। তবে, গত ১০ নভেম্বর বিআইডব্লিউটির পক্ষ থেকে কুষ্টিয়া নাটোর ও পাবনার জেলা প্রশাসক এবং কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার পুলিশ সুপারকে এই বালু উত্তোলন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠায়। কিন্তু তারপরেও থেমে নেই বালুখোদের তৎপরতা।
সূত্রে জানা গেছে, আবেদুর রহমান অন্নু নদীতে বালুর ট্রলার থেকে জেলা প্রশাসকের মৌখিক নির্দেশনায় ট্রলার থেকে খাস আদায় বা টাকা কালেকশন করতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে- তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে নৌকা থেকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে মেসার্স মোল্লা ট্রের্ডাস নামের একটি প্রতিষ্ঠান নাটোর জেলার লালপুর উপজেলাধীন পদ্মানদীর দিয়ার বাহাদুরপুর বালু মহালের বৈধ ইজারাদার। তিনি ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকায় ওই বালু মহল ই যারা নিয়েছেন। এর বাইরে কুষ্টিয়া পাবনা ও নাটোর জেলায় আর কোন বৈধ বালু উত্তোলনকারী ইজারাদার নেই।’
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, একসময়ের বৈধ ইজারাদার মেসার্স বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মেসার্স আনোয়ারুল হক মাসুম নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান যথাসময়ে বালু উত্তোলনে সক্ষম হয়নি- এমন দাবি করে দীর্ঘ ১৭-১৮ বছর ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে। এতে সরকার শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই চক্রটির কারণে বর্তমানে বৈধ ইজারাদার মোল্লা ট্রেডার্স মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ, শাওন এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স আনোয়ারুল হক মাসুম লোকজন নাটোর কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ পদ্মা নদীর একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছে।
সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকৃত লোক ও ক্যাডাররা সশস্ত্র অবস্থায় দিনরাত নদীতে পাহারায় থাকে। তাদের পাহারায় প্রতিদিন শতাধিকেরও বেশি নৌকা ও বাল্কহেড দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। এমন অবস্থায বৈধ ইজারাদার মোল্লা ট্রের্ডাসের প্রোপাইটর শহিদুল ইসলাম বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন। এর প্রেক্ষিতে গত ১০ নভেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন (বিআইডব্লিউটিএ) প্রশাসন ও মানবসম্প বিভাগের পরিচালক কাজী ওয়াকিল নওয়াজ কুষ্টিয়া, পাবনা ও নাটোরের জেলা প্রশাসক এবং কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার পুলিশ সুপারকে অবৈধভাবে বালু উৎপন্ন বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠান।
শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ঈশ্বরদীর সারাঘাট ও কুষ্টিয়ার হরিপুর সীমান্তে জাকারিয়া পিন্টু ও টনি বিশ্বাস অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত কয়েক দিন আগে প্রশাসন উল্টো আমার বৈধ ইজারার টিকিট কাউন্টার ও রান্নাঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। প্রশাসনের কাছেও হ্যারেজমেন্ট হচ্ছি। আমার বালুঘাটে যেসব নৌকা আসে তাদেরকে মারধর করে টাকা পয়সা করে নিচ্ছে টনি বিশ্বাসের লোক। আমি এর প্রতিকার চাই।’
এদিকে কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘কাউকে বালু উত্তোলনের কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাই, কোন খাস আদায়ের প্রশ্নই ওঠে না। বিআইডব্লিউটিএর চিঠিতে সরাসরি বলা হয়েছে বালু উত্তোলনের পারমিশন কারও নাই৷ যে বা যারা তুলছে- এটা অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে।’
লক্ষ্মীকুন্ডা নৌ পুলিশের (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন আমরা নদীতে টহল দিচ্ছি। আমরা চিঠি পেয়েছি। আমাদের দেখলেই সব পালিয়ে যায়।’
কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘চিঠিতো আগেও আসছে। চিঠিটা আমাকে দেখতে হবে। এগুলো আমাদের আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা ও চিঠিপত্রের আলোকে আমরা কাজ কবো।’
কেকে/এমএ