বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক রুইজাতীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘মৎস্য হেরিটেজ এলাকা’ ঘোষণা করেছে সরকার। নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণের লক্ষ্যে আরোপ করা হয়েছে ১৭টি কঠোর নিষেধাজ্ঞা।
বুধবার (৫ নভেম্বর) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত সরকারি গেজেট প্রকাশ করেছে। গেজেটে বলা হয়, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হালদা নদী রুইজাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হিসেবে অনন্য। এখানকার রুইজাতীয় মাছ জেনেটিক্যালি বিশুদ্ধ। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত নদীতে প্রজননের ফলে প্রচুর নিষিক্ত ডিম পাওয়া যায়। একই সঙ্গে নদীটি বিপন্ন গাঙ্গেয় ডলফিনেরও আবাসস্থল। হালদা নদী ও এর তীরবর্তী ২৩ হাজার ৪২২ দশমিক ২৮ একর এলাকা ‘হালদা নদী মৎস্য হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকারি গেজেট অনুযায়ী, হালদা নদী ও আশপাশের এলাকায় নিম্নলিখিত বিধিনিষেধগুলো এখন থেকে কার্যকর :
(১) নদী থেকে কোনো প্রকার মাছ বা জলজ প্রাণী ধরা বা শিকার করা যাবে না।
(২) মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট সময়েই কেবল নিষিক্ত ডিম আহরণ করা যাবে।
(৩) প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
(৪) নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা যাবে না।
(৫) মাছ, ডলফিন বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কাজ করা নিষিদ্ধ।
(৬) বসতবাড়ি বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের পয়ঃবর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না।
(৭) নদীর বাঁক কেটে সোজা করা যাবে না।
(৮) ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৭টি সংযুক্ত খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।
(৯) নতুন রাবার ড্যাম বা কংক্রিট ড্যাম নির্মাণ করা যাবে না।
(১০) তদারকি কমিটির অনুমতি ছাড়া পানি শোধনাগার বা সেচ প্রকল্প থেকে পানি উত্তোলন করা যাবে না।
(১১️) দেশি বা বিদেশি কেউ অনুমতি ছাড়া গবেষণা পরিচালনা করতে পারবে না।
(১২️) নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
(১৩️) কর্ণফুলী মোহনা থেকে নাজিরহাট ব্রিজ পর্যন্ত ভারী ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ।
(১৪️) হালদা ও এর শাখা নদীতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া যাবে না এবং ড্রেজার ব্যবহার বন্ধ থাকবে।
(১৫️) নদীর অববাহিকায় তামাক চাষ নিষিদ্ধ।
(১৬️) কৃষিজমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
(১৭️) নদীর পাড়সংলগ্ন এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না।
গেজেটে আরও বলা হয়েছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন বা পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটলে এলাকাভিত্তিক সীমারেখা ও বিধিনিষেধ সময়মতো হালনাগাদ করা হবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মন্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘হালদা এখন দেশের গর্ব। হালদা শুধু একটি নদী নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। সরকারের এই ঘোষণা নদী রক্ষায় নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।’
স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা বলছেন, ‘হালদা নদীকে ‘মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণ ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।’
প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ‘এসব নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে কাজ করবে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন করা হবে।’
হালদা নদী দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক রুইজাতীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের আওতায় ছিল। এবার সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশের প্রথম মৎস্য হেরিটেজ এলাকা হিসেবে।
কেকে/বি