পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে রাশিয়া গিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেন যুদ্ধে গিয়ে নিহত হয়েছেন রাজবাড়ীর নজরুল ইসলাম (৪৭) নামে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্য।
বুধবার (৮ অক্টোবর) নিখোঁজের প্রায় সাড়ে ৫ মাস পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৃত্যুর বিষয়িট নিশ্চিত হন নজরুলের পরিবার।
২৮ ফেব্রুয়ারী (২০২৫) দালাল ফরিদ হোসেনের মাধ্যমে রাশিয়ায় যান সাবেক সেনা সদস্য নজরুল। ১ মাসের মত পরিবার ও স্বজনদের সাথে যোগাযোগ ছিল। তিনি গত ৩০ এপ্রিলের পর থেকে নিখোঁজ।
এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ৪ কন্যা সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে এ বছর রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং ২য় মেয়ে ৫ম শ্রেণির ছাত্রী। তাছাড়া তার ছোট দুই মেয়ের বয়স মাত্র ৫ ও ৬ বছর।
নিহতের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসীর দাবি, নজরুল খুব ভাল মানুষ ও ক্রীড়াপ্রেমী ছিলেন। সবার সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করত। সেনাবাহিনী থেকে অবসরে আসার পর স্থানীয় শ্রীপুর বাজারে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
কোলারহাটের দালাল ফরিদ তাকে ভাল বেতনের চাকরির মিথ্যা প্রলেভোন দেখিয়ে ফুসলিয়ে ১৩ লক্ষ টাকা নিয়ে রাশিয়াতে পাঠায়। ওখানে যাওয়ার পর জোর করে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। সবশেষ ৩০ এপ্রিল সে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলেছিল এবং ওইদিন দেশে তার ১৩ লক্ষ টাকা পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু কিছুই পাঠাতে পারেন নাই।
এ অবস্থায় নিহত নজরুলের স্ত্রী আইরিন আক্তার ছোট ছোট ৪ কন্যা সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। সেই সাথে নিহত নজরুলের মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থাসহ দালাল ফরিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন এবং অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়াতে নিহতের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন ।
নিহত নজরুল ইসলাম রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের চর রামকান্তপুর গ্রামের মৃত. হাতেম আলী ফকিরের ছেলে। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান।
তিনি অবসরে যাওয়ার আগে ২০১৩ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন কঙ্গোতে অংশ নিয়েছিলেন। অবসরের পর নিজ এলাকায় বাঁধাই মালের ব্যবসা শুরু করলেও লোকসানের কারণে আর্থিক সংকটে পড়েন। এ সময় স্থানীয় দালাল ফরিদ হোসেনের মাধ্যমে রাশিয়ায় নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির প্রলোভনে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার যান। সেখানে পৌছানোর পর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে পাঠানো হয় ইউক্রেন যুদ্ধে। সবশেষে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে তিনি পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ মেলেনি। হঠাৎ গতকাল ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিবারকে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
নিহতের স্ত্রী বলেন, আমার সব শেষ। ছোট ছোট ৪ মেয়ে নিয়ে আমি কি করবো। দালালের খপ্পরে পরে ফেব্রুয়ারিতে সে রাশিয়া যায় এবং ৩০ এপ্রিলের পর থেকে নিখোঁজ ছিল। হঠাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি সে মারা গেছে। রাশিয়া যাওয়ার পর জোর করে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। ওখানে যাওয়ার পর সে আমাকে ফোনে বলেছিল এখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব না। ৪ মেয়েসহ তোমাকে আল্লাহর হাতে তুলে দিলাম। আল্লাহ দেখে রাখবে। ৩০ এপ্রিল ছিল তার সাথে আমার সব শেষ কথা।
তাছাড়া ওইদিন তার ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু জরুরী ডাক পড়ে যাওয়ায় টাকা পাঠাতে পারে নাই। এরপর থেকে তার সাথে আর কোন যোগাযোগ নাই। আপনারা আমার স্বামীর লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। আমার সন্তানরা যেন শেষবারের মত তাদের বাবাকে দেখতে পারে এবং দেশের মাটিতে যেন তাকে দাফন করতে পারি। আমি দালালের শাস্তি চাই। আর কোন পরিবারকে যেন এভাবে শেষ করতে না পারে।
নিহতের ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম ও বোন নাছিমা বেগম বলেন, আমার ভাইকে রাশিয়া নিয়ে যে কাজ দেয়ার কথা ছিল সেই কাজ না দিয়ে আটকে রেখে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে যুদ্ধে পাঠানো হয়। এপ্রিল মাসের শেষের দিক থেকে সে নিখোঁজ ছিল। এরপর আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেছি। হঠাৎ গত ৮ তারিখে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয় আমার ভাই ওই দেশে মারা গেছে। ১৩ লক্ষ টাকা নিয়ে এই দালাল আমার ভাইকে রাশিয়াতে পাঠিয়েছিল। তার সাথে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সে কথা বলে নাই। এই দালালের কঠিন বিচার হওয়া দরকার এবং সে যেন আর এ ধরনের কাজ করতে না পারে সে ব্যবস্থা যেন সরকার নেয়। একই সাথে তার লাশ দেশে আনতে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছি। আমরা লাশ দেশে আনতে চাই। আমার ছোট ভাইয়ের ছোট ৪টি মেয়ে এতিম হয়ে গেল। সরকার যদি এই পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে পরিবারটি বাঁচতে পারবে।
নিহতের স্বজন ও প্রতিবেশীরা বলেন, নজরুল খুব ভাল এবং একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ ছিলেন। এলাকার ছোট বড় সবার সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলতেন। দালালের খপ্পরে পরে রাশিয়াতে গিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে নিখোঁজ ছিল। হঠাৎ জানতে পেরেছি তাকে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল এবং যুদ্ধ করতে গিয়ে সে মারা গেছে। এ দায় সম্পূর্ণ দালালের, তাকে ধরে শাস্তির আওতায় আনা উচিত। সেই সাথে আমরা চাই নজরুলের লাশ দেশে এনে দাফন করা হোক। আর তার পরিবারে উপার্জন করার মত আর কেউ নেই। তাই সরকার যেন এই অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ায়।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, এরকম ঘটনা ঘটলে দুতাবাস থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে এবং পরে সেখান থেকে আমাদের চিঠি দেয় অথবা তারা নিজরাই ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমাদরকে অনুলিপি দেয। সেক্ষেত্রে আমি সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে কপি দেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ধরনের কোন চিঠি আসে নাই। চিঠি পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
কেকে/বি