ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে ডা. কামাল আহমেদ নামে স্থানীয় চিকিৎসককে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ তিনি একাধারে ৮টিরও বেশি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক এবং শেয়ারহোল্ডার। দায়িত্বের চেয়ে ব্যবসায়ে সময় বেশি দেন তিনি। আর সেই চিকিৎসকই আবার ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হয়ে যোগ দিচ্ছেন নিজ উপজেলায়। ফলে, প্রশ্ন উঠেছে চিকিৎসা সেবা পাবে মানুষ, নাকি ব্যবসায়ের কবলে পড়বে হাসপাতাল?
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ পৌর শহরের রঘুনাথপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে কামাল আহমেদ। গত সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জারি করা আদেশে তাকে কুড়িগ্রাম ২৫০ বেড জেলা হাসপাতালের আরএমও পদ থেকে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু এ বদলি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। কারণ, তার বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ডা. কামাল পৌর শহরের অ্যাপোলো ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গ্লোবাল ডায়াগনস্টিক এন্ড ভ্যাকসিন সেন্টার, হিমালয় ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কেয়ার ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টার, একতা নার্সিং হোম ও আধুনিক ক্লিনিকসহ অন্তত ৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বোচাগঞ্জ ও রানীশংকৈল উপজেলার বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকেও তার বিনিয়োগ রয়েছে।
জানা গেছে, কামাল আহমেদ ২০১৪ সালে পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরএমও (আবাসিক মেডিকেল অফিসার) থাকাকালে স্থানীয়ভাবে ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক ব্যবসায়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন। হাসপাতালের ডিউটি বাদ দিয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশি সময় দিতে থাকেন তিনি। এ নিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আব্দুল মজিদ প্রতিবাদ করলে তার সাথে বিরোধে জড়ান ডা. কামাল। কিন্তু সে সময় কামাল সরকারি দল সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাথে যুক্ত থাকায় তার বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মজিদ। স্বাচিপের ছত্র ছায়ায় থেকে তিনি হাসপাতালের দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে দিন-রাত ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সময় দিয়ে সে সময় লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। মাঝে মধ্যে হাসপাতালে দুয়েক ঘন্টা সময় দিলেও রোগী, রোগীর স্বজন, হাসপাতালের স্টাফ ও হাসপাতালে আসা স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে খারাপ আচরণ করতেন। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়া এবং অসদাচরণের অভিযোগে তখন তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও হয়। নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে পীরগঞ্জ উপজেলা উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে জেলার বাইরে বদলি করা হয়। জেলার বাইরে চাকরি করার সময়ও তিনি প্রায়ই ফাঁকি দিয়ে পীরগঞ্জ ও এর আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সময় দিয়েছেন।
কোষারাণীগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল হাকিম জানান, বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ডা. কামাল একাধিক শেয়ার নিয়ে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করেছেন। সরকারি হাসপাতালের রোগীদের নানা অজুহাতে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। তিনি এখানে আসলে চিকিৎসা সেবা ব্যবসায়ে পরিণত হয়ে উঠবে।
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোকাদ্দেস হায়াত মিলন বলেন, ‘ডা. কামাল এর আগে নামমাত্র দায়িত্ব পালন করেছেন। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি বেশি সময় দেন। তাকে আবার দায়িত্ব দিলে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে আরও বঞ্চিত হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতাল গেট এলাকার নাসিমা বেগম বলেন, ‘যে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক স্বার্থের অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হলে চিকিৎসা নয়, ব্যবসায়ই প্রাধান্য পাবে।’
পৌর শহরের গোলাম রব্বানী নামে ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, ‘স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিজ উপজেলায় বদলি হওয়ার সুযোগ না থাকলেও ডা. কামাল সেই সুযোগ পেয়েছেন। আর এ নিয়োগ ঘিরেই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে সরকারি হাসপাতাল কি সত্যিই স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্র হয়ে থাকবে, নাকি তা পরিণত হবে ব্যবসায়ের অঙ্গনে?’
একজন স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডা. কামালকে শেয়ার না দিলে তিনি রোগী পাঠান না। বাধ্য হয়ে আমরা তাকে অংশীদার করেছি।’
জানতে চাইলে কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমি কোনো ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক নই। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। অতীতের সব কিছু বাদ দিয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে পীরগঞ্জের মানুষকে সেবা দিতে চাই।’
ঠাকুরগাঁও জেলা সিভিল সার্জন ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘এটি বিভাগীয় বিষয়। যা করার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করেছে। এখানে আমার কিছু করার নেই।’
কেকে/ এমএ