জন্মদিনের মাত্র ১০ দিন আগে ইসরায়েলি হামলায় শহিদ হলেন ইরানের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবি পারনিয়া আব্বাসি। তিনি ছিলেন একজন কবি, ইংরেজি শিক্ষিকা এবং ব্যাংককর্মী। অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল তার—আরো কিছু করার, আরো কিছু হওয়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল, যখন তেহরানের সত্তারখান স্ট্রিটের অর্কিড কমপ্লেক্সে তাদের অ্যাপার্টমেন্টে একটি মিসাইল আঘাত হানে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার (১৩ জুন) ভোররাত ৩টা ৩০ মিনিটে, ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানের সত্তারখান এলাকার একটি আবাসিক ভবনে মিসাইল হামলা চালায়। ওই ভবনের অর্কিড কমপ্লেক্স-এর ৪ নম্বর ব্লকে পারনিয়া তার পরিবারসহ বসবাস করতেন। এতে পরিবারের চার সদস্যই ঘুমন্ত অবস্থায় প্রাণ হারান।
হামলার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে একটি হৃদয়বিদারক দৃশ্য—একটি গোলাপি বিছানায় রক্তের দাগ, তার পাশেই ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে বেরিয়ে আছে এক নারীর চুলের গোছা। জানা যায়, সেটিই ছিল পারনিয়া আব্বাসির বিছানা।
‘আমি পুড়ি
আমি হয়ে যাব সেই নিভে যাওয়া তারা
তোমার আকাশে
ধোঁয়ার মতো...’
পোড়া, নিভে যাওয়া, ধোঁয়ায় মিশে যাওয়ার কথা যে তরুণী লিখেছিলেন, তিনিই ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিশে গেলেন।
পারনিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মরিয়ম জানান, শুক্রবার সকাল ১১টায় তাদের দেখা করার কথা ছিল। বিস্ফোরণের খবর শুনেই তিনি ছুটে যান ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখেন—অর্কিড বিল্ডিংয়ের ৪ নম্বর ব্লক সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। পারনিয়ার অ্যাপার্টমেন্টের কোনো চিহ্নও নেই।
সে সদ্য জাতীয় স্নাতকোত্তর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু ব্যাংক মেল্লির কেন্দ্রীয় শাখায় চাকরির কারণে ভর্তি স্থগিত রেখেছিল। ‘সে আমার সবকিছু ছিল’, হাম-মিহান পত্রিকাকে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলেন মরিয়ম।
মরিয়ম জানান, মিসাইলটি ভবনের ঠিক মাঝ বরাবর আঘাত হানে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা সম্পূর্ণ ধসে পড়ে। প্রথম যাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্যে পারনিয়াই ছিলেন প্রথম। এরপর উদ্ধার হয় তার ১৬ বছর বয়সী ছোট ভাই পারহামের মরদেহ। পরে উদ্ধার করা হয় তার মা মাসুমেহ শাহরিয়ারি (সাবেক ব্যাংককর্মী) ও বাবা পারভিজ আব্বাসির (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক) মরদেহ।
পারনিয়া আব্বাসি ছিলেন ইরানের নবীন প্রজন্মের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। তার কবিতা ছিল আবেগঘন, গভীর ও দার্শনিক। তার সবচেয়ে আলোচিত কবিতা ‘The Extinguished Star’ (নিভে যাওয়া তারা) প্রকাশিত হয় ইরানের খ্যাতনামা সাহিত্য সাময়িকী Vazn-e-Donya-এর জেনারেশন জেড সংখ্যায়।
সেই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন—
‘আমি কেঁদেছিলাম দুজনের জন্য
তোমার জন্য
এবং আমার জন্য...’
‘তুমি আর আমি একদিন শেষ হয়ে যাব
কোনো একখানে
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটিও
নিস্তব্ধ হয়ে যাবে...’
এই পঙ্ক্তিগুলো তিনি এক সময় একটি খাতায় লিখেছিলেন।
পারনিয়া ঘাজভিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি অনুবাদে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন শিক্ষাদান প্রিয়, দায়িত্বশীল ও সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে নিবেদিত। চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর শিক্ষার সুযোগ পেলেও তা স্থগিত রেখেছিলেন পরিবারের প্রয়োজনে।
ইরানি গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এই হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন পারনিয়াদের ভবনে থাকা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ও বেহেশতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল হামিদ মিনোচেহর। তিনি নিহত হয়েছেন কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত দেশটিতে অন্তত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন।
সূত্র : দ্য অবজারভার পোস্ট, তেহরান টাইমস
কেকে/এএম