এই সময়ের বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র, টেলিভিশন নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্র, সংগীতচিত্র ও দৃশ্যমাধ্যমের অগ্রণী একজন সিনেমাটোগ্রাফার, যিনি কেবল নিছক ক্যামেরা অপারেটর নন বরং প্রতিটি ফ্রেমে জড়িয়ে দেন অনুভব, অন্তর্দৃষ্টি ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনা—তিনি হচ্ছেন মিঠু মনির। পুরো নাম মনির হোসেন, চলচ্চিত্রাঙ্গন তথা বাংলাদেশের ফিল্ম ও মিডিয়াঅঙ্গনে যিনি ‘মিঠু মনির’ নামে সম্মানের সাথে পরিচিত। সমকালীন বাংলাদেশি সিনেমাটোগ্রাফির জগতে যার নাম উচ্চারণ মানেই সূক্ষ্মতা, নান্দনিকতা এবং এক নির্মোহ অথচ সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির কথা—সকলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের ফিল্ম ও মিডিয়ায় অভ্যন্তরীণভাবে তার একটি কাজ নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে। আর সেই কাজটি হলো—'জামদানি’ চলচ্চিত্র।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো স্বীকৃত জিআই পণ্য এবং বাংলাদেশের গৌরব 'জামদানি' শাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য, কারিগর ও সমাজ-অর্থনীতির অন্তর্জগৎকে উপজীব্য করে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র ‘জামদানি’। যা পরিচালনা করেছেন অনিরুদ্ধ রাসেল। এই চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফারের দায়িত্ব পালন করেছেন মিঠু মনির। আর এ কাজেই তিনি যেন নিজের সবটুকু মেধা, মনন, সংবেদন ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছেন প্রতিটি দৃশ্য ধরনের মাধ্যমে।
জামদানি শাড়ির বুনন যেমন সূক্ষ্ম, নিপুণ ও ধৈর্যের দাবি রাখে—তেমনই এই উপজীব্যে নির্মিত ‘জামদানি’ চলচ্চিত্রটিতে মিঠু মনিরের ক্যামেরার কাজও একেকটি দৃশ্যে তুলে ধরেছে চরিত্রের অন্তর্জগৎ, পরিবেশ-প্রতিবেশের স্পন্দন এবং সময়ের নিঃশব্দ বেদনা। তার ফ্রেমে শুধু পোশাক নয়, ধরা দিয়েছে একেকজন কারিগরের কষ্ট, মহাজনের দম্ভ, দাদন ব্যবসায়ীর রক্তচক্ষু এবং নীরবে হারিয়ে যেতে থাকা এক ঐতিহ্যের দীর্ঘশ্বাস। মুক্তি প্রত্যাশিত চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করে সরকারি অনুদান যাচাই কমিটির একাধিক সদস্য মন্তব্য করেছেন—পুরো ‘জামদানি’ ছবির দৃশ্যায়নে এমন শৈল্পিক-নান্দনিকতা ও মুন্সিয়ানার ছাপ আজকের প্রজন্মের সিনেমাটোগ্রাফারদের মধ্যে বিরল।
বাংলাদেশের ফিল্ম মিডিয়া অঙ্গনে মিঠু মনিরের প্রশংসিত এই যাত্রা বা আজকের শক্তিশালী অবস্থান হঠাৎ করে শুরু হয়নি। নিরলস পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও শিখতে চাওয়ার প্রবল আগ্রহই তাকে এ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিনেমাটোগ্রাফির উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর নিজেই ক্যামেরা হাতে তুলে নেন পেশাগতভাবে। ঢাকায় বিবিসি-তে এক বছর সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা, আইসিসি টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপ ২০২৪ এর ম্যাচে লাইভ ক্যামেরা পরিচালনা, নানা ঘরানার তথ্যচিত্র, টেলিভিশন নাটক, গানচিত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র—সবখানেই রেখেছেন মেধার উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫০টি টেলিভিশন নাটক, শতাধিক তথ্যচিত্র, ৫০ টির বেশি গানচিত্র এবং ৩০০টিরও বেশি বিজ্ঞাপনচিত্রে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। তবে তিনি সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন চলচ্চিত্রের কাজে।
তার ক্যামেরায় প্রাণ পাওয়া অন্যান্য চলচ্চিত্র—‘গন্তব্য’ (পরিচালক: অরণ্য পলাশ), ‘ইন্দুবালা’ (পরিচালক: অনন্য মামুন) 'ম্যাকআপ’ (পরিচালক: অনন্য মামুন) 'কালো মেঘের ভেলা' (পরিচালক : মৃত্তিকা গুণ ) ও ‘হৃদয় জুড়ে’ (পরিচালক: রফিক শিকদার) হৃদয় জুড়ে চলচ্চিত্রের জন্য সংগীত পরিচালক হিসেবে ২০২১ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন 'বেলাল খান' । এইগুলো মিঠু মনিরেৱ সিনেমাটোগ্রাফির মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে—‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (পরিচালক: অনিরুদ্ধ রাসেল), ‘অ্যানকাউন্টার’ (পরিচালক: অনিরুদ্ধ রাসেল), ‘ম্যাকআপ’ (পরিচালক: অনন্য মামুন), ‘বেসামাল’ (পরিচালক: রাহুল রওশন) এবং সরকারি অনুদানে ‘রুখসার’ (জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান পরিচালক : মোস্তাফিজুর রহমান মানিক)।
প্রতিটি কাজের শুরুতেই মিঠু মনির সংশ্লিষ্ঠ চিত্রনাট্যটি মনোযোগের সাথে পাঠ করে, পরিচালক ও টিমের প্রয়োজনীয় সদস্যদের সঙ্গে পুনঃপুনঃ মিটিংয়ে বসেন। কারণ, তার মতে—ভালো সিনেমাটোগ্রাফি কেবল শট নেওয়া নয়, প্রতিটি দৃশ্যের অনুভব বুঝে তার ভিজ্যুয়াল-ভাষা ফুটিয়ে তোলাই একজন প্রকৃত সিনেমাটোগ্রাফারের দায়িত্ব। এই মনোভাবই তাকে এবং তার কাজকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে। তিনি বলেন—সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমি চলচ্চিত্রের কাজটাকে ভালোবাসি। এই বড় ক্যানভাসে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজটা করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, প্রতিটি ফ্রেমই বলে দেয়—একজন সিনেমাটোগ্রাফার কতোটা শিল্পী। আমি ক্যামেরার শিল্পী হয়ে বাঁচতে চাই।
মিঠু মনির আমাদের সেই চিত্রকর, যিনি তুলি ব্যবহার না করে আলো ও ছায়া দিয়ে আঁকেন ক্যানভাস। আর তার আঁকা ‘জামদানি’ সিনেমার প্রতিটি ক্যানভাস বা দৃশ্য যেন বাংলাদেশি ঐতিহ্যের জীবন্ত এক দলিল। ভবিষ্যতের বাংলা ও বিশ্ব চলচ্চিত্রে তিনি হোন এক অনুপ্রেরণার নাম—এই প্রত্যাশা সকল চলচ্চিত্র অনুরাগীর।
কেকে/এআর