ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। নানা কিছুর উল্টোপাল্টো হয়েছে। তেমনই খালি হয়েছে অনেক মায়ের বুক। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিলে গিয়েও প্রাণ হারায় অনেকে। তাদেরই একজন মৌলভীবাজার জেলার শাহজাহান মিয়া। তার মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে গেছে পরিবারের আয়ের পথ। এখনও নিহতদের পরিবারের সদস্যরা শোক বহন করে চলছে। সেইসঙ্গে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, শাহজাহান মিয়া মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের সনকাঁপন গ্রামের বাসিন্দা হলেও জীবিকার প্রয়োজনে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ধরাতেপুর গ্রামে বসবাস করতেন। জীবিকার তাগিদে সিলেটে সিএনজি চালাতেন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৯নং আমতৈল ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের সনকাঁপন গ্রামের আরশ আলীর পুত্র শাহজাহান মিয়া। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার পতনের খবরে বিজয় উল্লাসের মিছিলে নেমেছিলেন শাহজাহান। সিলেট দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে শাহজাহানসহ আরো বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েই শহিদ হন শাহজাহান। মৃত্যুর সময় তার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ১২ আগস্ট জন্ম নেয় তার কন্যাসন্তান, যে বাবার মুখ দেখার আগেই এতিম হয়ে যায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অভাব-অনটনে পড়েন স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা।
সরেজমিনের শহিদ শাহজাহান মিয়ার ছোট কুটিরে গেলে তার বাবা আরশ আলী মিয়া বলেন, আমার ছেলে শাহজাহান সিলেটে থেকে সিএনজি চালাত। প্রতি সপ্তাহে বা পনের দিনে বাড়িতে এসে পরিবারের খরচ দিয়ে যেত। গত বছর ৫ আগস্টের সরকার পতনের পর সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে শহিদ হয়। এখনো আমরা আমাদের ছেলের লাশ পাইনি। আমরা ভিডিওতে দেখেছি কীভাবে তাকে গুলি করে মারা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শাহজাহান মারা যাওয়ার ৭দিন পর কন্যা জন্ম দেন তার স্ত্রী। ওই সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারেননি শাহজাহান, সন্তানও কোনোদিন দেখবে না বাবার মুখ।
নিহত শাহজাহানের স্ত্রী বলেন, বিজয় উল্লাস যে শোক বয়ে আনবে তা বুঝতে পারেনি আমার স্বামী। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে সবার সঙ্গে রাস্তায় নেমে ছিলেন তিনি। এখনও তার লাশটা খুঁজে পাওয়া গেল না। আমার স্বামী নিহত হওয়ার এক সপ্তাহ পর আমাদের এক কন্য সন্তানের জন্ম হয়। পুলিশের গুলি গুঁড়িয়ে দিয়েছে আমাদের পরিবারের সব স্বপ্ন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে ছোট মেয়েসহ পুরো পরিবার নিয়ে জীবন চলানো যে কতটা যন্ত্রণার তা কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। স্বামীর কথা মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্ত্রী ও মা-বাবা। গত দুইটি ঈদের আনন্দ যেন বিষাদের ছায়া হয়ে নেমেছিল পরিবারটিতে।
প্রতিবেশীরা জানান, শাহজাহানের অনুপস্থিতিতে তার পরিবার চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সনকাঁপন গ্রামের বাসিন্দা প্রতিবেশি জাহানারা বেগম জানান, সিলেটে সিএনজি চালিয়ে কোনো রকম সংসার চালাত শাহজাহান। প্রতি ঈদে তার মা ও বাবার জন্য কাপড় কিনে আনতো। গত দুইটি ঈদে এই পরিবারটিতে কোনো আনন্দ ছিল না। তার মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে গেছে পরিবারের আয়ের পথ। পরিবারটি খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আব্দুর রহমান বলেন, শাহজাহান মিয়ার আয়ের ওপর পরিবারটি নির্ভর ছিল। তার ১১ মাস বয়সী শিশুসন্তানসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্য রয়েছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে স্বজনদের চোখের সামনে শুধু অন্ধকার। আশা করছি সরকারসহ জুলাই আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা তাদেরকে পাশে দাঁড়াবে।
কেকে/এজে