‘পুলিশ নিজেদের মত করে চার্জশিট প্রস্তুত করেছেন। আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। পুলিশ তাদের ইচ্ছেমত আসামি রেখেছেন চার্জশিটে। অনেক আসামি বাদ দিয়েছেন। তারা চার্জশিট প্রস্তুত করে আমাদেরকে ফোন দিয়েছে, আমাদের নাকি স্বাক্ষর লাগবে। আমরা বলে দিয়েছি- চার্জশিট প্রস্তুত করার সময় যখন আমাদেরকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করেননি, এখন আমাদের স্বাক্ষরের কি দরকার?’শুক্রবার (২১ ডিসেম্বর) বিকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন এসব কথা বলেন কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরাবাজার থানার কড়ই বাড়ির চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডারে মা, ভাই ও বোন হারানো রুমা আক্তার ও তার বোন রিক্তা আক্তার।
গত ৪ জুলাই কড়ই বাড়িতে নানা অভিযোগ এনে নিজ বাড়ির সামনে রোকসানা বেগম রুবি, তার মেয়ে জোনাকি আক্তার ও ছেলে রাসেল মিয়াকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনার দুই দিন পর রিক্তা আক্তার বাদী হয়ে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে, রিক্তা আক্তারের করা মামলার ১৩৩ দিন পর ডিবি পুলিশ যে চার্জশিট আদালতে পাঠিয়েছে, সেই চার্জশিট থেকে অনেক আসামি বাদ দেওয়া হয়েছে।
চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া আসামিরা হলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বাবা বিল্লাল মাস্টার, মুসলেমের ছেলে শরীফ, নান্নু মিয়ার ছেলে মোস্তফা, তাজুল ইসলামের ছেলে শাহপরান, বাচ্চু মেম্বারের ছেলে রানা, রবিউলের ছেলে বায়েস মাস্টার, ফারুক মোল্লার ছেলে রাফি মোল্লা, রফিকের ছেলে বিজয়, হারুনের ছেলে বাবু, মৃত আবদুল খালেক ছেলে জুয়েল, বেদনের ছেলে শাহাদাত, জাহেরের ছেলে অনিক, ফারুক মোল্লার ছেলে সাইফুল্লা, আজিজ ছেলে আমির জাহান, তাহের ছেলে শাহ আলম ও সাইদুল। এছাড়া আরো অনেককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে রুমা আক্তার ও তার বোন রিক্তা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই মামলায় অনিয়ম করেছেন। গ্রেফতারের নামে নিরীহ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। এছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা যারা ছিল, তাদের একজনকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। কুমিল্লা ডিবি পুলিশের হাতে এই মামলা থাকলে আমরা কখনও আমাদের মা-ভাই-বোন হত্যার বিচার পাবো না।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার (১৬ নভেম্বর) কুমিল্লা ডিবি আদালতে কড়ই বাড়ির চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডারে চার্জশিট পাঠিয়েছে। এর আগে ৭ জন নামীয় ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ৯জনসহ মোট ১৭ জনকে গ্রেফতার হয়েছে। চার্জশিটের এজাহারে ৩১ জন নামীয় ও ১৯ জন অজ্ঞাতনামা আসামী রাখা হয়েছে।
সংংবাদ সম্মেলনে রুমা আক্তার বলেন, ‘আসামিদেরকে বিভিন্নভাবে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাদের মামলা উঠিয়ে নিতে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হত্যার হুমকি দিয়েছে। এখন পুলিশ চার্জশিট নিয়ে এই কাজটা করেছে। আমরা কার কাছে যাবো। আমরা কি আমাদের মা-ভাই-বোন হত্যার বিচার পাবো না। আজ কত দিন হয়ে গেলো কয়েকজন ছাড়া, মূল আসামী কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি ডিবি পুলিশ।’
মা-ভাই-বোনকে হত্যার দুই দিন পর উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের লোকজনের চাপে পড়ে আমরা একটি মামলার কাগজের স্বাক্ষর করি- এমন দাবি করে রিক্তা আক্তার বলেন, ‘এ মামলায় ৩৮ জনের নাম রাখা হয়েছিল। কিন্তু আসামি আরও বেশি। এ হত্যাকাণ্ডে কম করে হলে ৬০-৭০ জন জড়িত। তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা পুলিশকে বহুবার বলেছি আসামী আরও আছে, আপনারা তাদের গ্রেফতার করেন। তাদের নাম মামলায় রাখেন। পুলিশ রাখেননি তাদের নাম।’
পুলিশকে উদ্দেশ্য করে রিক্তা আক্তার বলেন, ‘এসব বন্ধ করেন। তা না হলে পুলিশের ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে যাবে। মামলায় যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছেন, তাদেরকে কোন ধারাই দেননি। আসামি ধরার সময় আমরা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এই আসামী না ধরার পিছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে- উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। আমরা শুধু সঠিক বিচার চাই।’
নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রীর মিম আক্তার বলেন, ‘ওরা এখনও আমাদেরকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়। আমাকে ফোন দিয়ে বলে- তোর স্বামীকে তো কুপিয়ে মারছি, আর তোরে পেলে ২০-৩০ জন মিলে ধর্ষণ করে মেরে ফেলবো। আমরা এই মানুষদের কাছ থেকে মুক্তি চাই।’
কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ই বাড়ির চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর এ মামলা চার্জশিট আদালতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে। আসামিরা আত্মগোপনে থাকায় গ্রেফতার করতে সমস্যা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ-পরিদর্শক নয়ন কুমার চক্রবর্তী খোলা কাগজকে বলেন, ‘আমরা চার্জশিট প্রস্তুত করার পর বাদী পক্ষকে জানিয়েছি। তারা আমাদেরকে কিছু জানায়নি। আপনি ফোন করে ভালোই করেছেন। আপনি ফোন দেওয়ায় নিশ্চিত হলাম বাদীপক্ষ চার্জশিটের বিষয়ে অবগত আছে।’