রাজশাহীর চারঘাটে এক সময়ের কর্মচঞ্চল ও কোলাহপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী পাদুকা পল্লী এখন টিকে থাকার মরণপণ লড়াই করছে। যেখানে এক সময় ৭০-৭৫টি কারখানায় দৈনিক শত শত জোড়া স্যান্ডেল ও জুতা তৈরি করা হত, সেখানে এখন দিনে ৫০ জোড়াও তৈরি হচ্ছে না। ভারতীয় স্যান্ডেলের আগ্রাসনে সংকুচিত হয়ে পড়েছে এখানকার স্থানীয় বাজার। ফলে, তীব্র মন্দা দেখা দিয়েছে এই শিল্পে।
এক দশক আগেও এই শিল্পপল্লীতে কয়েক হাজার কারিগর দিন-রাত জুতা-স্যান্ডেল তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। বর্তমানে এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০০-৩০০ জনে। পল্লীর বড়াল নদীর পাড় ঘেঁষে এখন সচল রয়েছে মাত্র ৭-৮টি কারখানা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘মেশিনে তৈরি ভারতীয় রাবারের স্যান্ডেলের টেকসই গুণ এবং দাম কমের কারণে হাতে ও আঠা দিয়ে তৈরি চারঘাটের চামড়ার স্যান্ডেল প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।’
গ্রামের দক্ষিণ ও পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়াল নদীর পাড়জুড়ে এখনও টিকে থাকা ৭-৮টি কারখানায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে জুতা-স্যান্ডেল তৈরির কাজ। বাঁশ-টিনের ছাউনির নিচে কারিগররা কেউ মাটিতে বসে, কেউ মেশিনের সামনে টুলে বসে কাজ করেন। মেশিনের একটানা শব্দ আর কাঠের ঠক ঠক আওয়াজে মুখরিত থাকে এই শিল্পপল্লী।
একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ ২৪ জোড়া স্যান্ডেল তৈরি করতে পারেন। এতে বিনিময়ে তাদের আয় ৬০০-৭০০ টাকা। তবে এর জন্য তাদের ১২-১৪ ঘণ্টা সময় দিতে হয়।
রাজশাহী কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র সাকিব সরকার নামের এক কারিগর জানান, কলেজ বন্ধ থাকলে তিনি স্যান্ডেল তৈরি করে দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করেন।
সুজুর আলী নামের আরেক কারিগর জমির কাজের পাশাপাশি এই কারখানায় কাজ করেন।
রাজ ‘সু’ কারখানার মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তার ওপর ভারত থেকে প্রচুুর পরিমাণে রাবারের স্যান্ডেল আমদানি হচ্ছে। ভারতীয় স্যান্ডেল টেকসই হলেও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু হাতে তৈরি চারঘাটের চামড়ার স্যান্ডেল শরীরের জন্য উপকারী হওয়া সত্বেও ভারতীয় স্যান্ডেলের দাপটে বাজার হারাচ্ছে হাতে তৈরি চামড়ার স্যান্ডেল।’
তিনি জানান, বহু ব্যবসায়ী ঋণের দায়ে কারখানা বন্ধ করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
রাজিব ‘সু’ কারখানার মালিক সোহেল রানা জানান, তাদের কারখানায় এক সময় ৭০-৮০ জন শ্রমিক কাজ করলেও এখন মাত্র ১৫-২০ জন কাজ করেন।
ন্যাশনাল ‘সু’ কারখানার মালিক মকছেদ আলী বলেন, ‘পাশের দেশ ভারত থেকে কম দামে ঝকঝকে ডিজাইনের স্যান্ডেল বাজারে ঢুকতেই স্থানীয় কারিগরদের কষ্টার্জিত পণ্য পিছিয়ে পড়ছে। আমদানিকৃত জুতা-স্যান্ডেলের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা। ফলে দেশীয় পাদুকা বাজার হারাচ্ছে ঐতিহ্য ও কদর।’
এক সময়ের সমৃদ্ধ এই পাদুকা পল্লী এখন তার অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে কঠিন সময় পার করছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহই পারে- এই শিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে।
কেকে/ এমএ