এবার মামলা বাণিজ্যের অভিযোগে আলোচনায় এসেছেন উত্তরের সীমান্তবর্তী নওগাঁর সাপাহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আজিজ। সম্প্রতি এক কৃষককে মাদক মামলায় ফাঁসানোর ঘটনায় আলোচনায় আসেন তিনি। বিষয়টি এখন টক অব দ্য টাউন। ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিচার দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে। ঘটনা অনুসন্ধানে পুলিশের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়নি তদন্ত কমিটি। ফলে এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। পুলিশ চলছে আগের মতোই লাগামহীন। সাপাহার থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশের একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ তাদের। এতে মানুষের আইনের প্রতি আস্থা নষ্ট হচ্ছে। তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইন প্রয়োগের দাবি সচেতন মহলের। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি আব্দুল আজিজ। তার দাবি—কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সুবিধা না পেয়ে এসব করছে। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, তদন্তে সত্যতা পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৪ জুলাই মধ্যরাতে জেলার সাপাহার উপজেলার পাতাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব কলমুডাঙ্গা (সাঁওতালপাড়া) গ্রামের কৃষক মামুনুর রশিদকে (৩২) নিজ বাড়ি থেকে আটক করে পুলিশ। এরপর মাদক মামলায় তাকে নওগাঁ কোর্টে পাঠায় সাপাহার থানা পুলিশ। বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকায় শুরু তোলপাড়। আন্দোলনে নামেন কলমুডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা। থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্যের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন এলাকাবাসী।
গত ৯ জুলাই বিকেলে কলমুডাঙ্গা গ্রামের সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে চৌমুহনী বাজার এলাকায় ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।
এ সময় তারা অবিলম্বে ভুক্তভোগী ওই কৃষকের মুক্তি, নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে হয়রানি; অর্থের বিনিময়ে পক্ষপাতমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সাপাহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আজিজ, এসআই মিলন কুমার সিংহ, এএসআই রেজোয়ানের বিচার এবং অবিলম্বে থানা থেকে প্রত্যাহার দাবি করেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে থানা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও মানববন্ধনে হুঁশিয়ারি দেন বক্তারা।
এর আগে তারা চৌমুহনী বাজারে একটি বিক্ষোভ মিছিল করেন। সেখানে ‘ওসি আব্দুল আজিজের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, মামুন ভাইয়ের মুক্তি চাই’, ‘বিচার বিচার বিচার চাই’, ‘ওসি আজিজের বিচার চাই’ বলে বিভিন্ন স্লোগান দেন স্থানীয় জনতা।
ভুক্তভোগী কৃষক মামুনের বাবা তাইজুল ইসলাম তাজেল সাংবাদিকদের বলেন, দু-তিন মাস আগে রাত ১২টার দিকে এএসআই রেজোয়ান কিছু পুলিশ নিয়ে হঠাৎ আমাদের বাড়িতে তল্লাশি চালায়। কারণ জানতে চাইলে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে এবং হুমকি দেয় ‘চুপ থাক, না হলে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেবো’।
গত ৪ তারিখ রাত ২টার দিকে মামুনকে ধরে নিয়ে যায় তারা। ভুক্তভোগীর স্ত্রীর দাবি- আমাদের প্রতিবেশী আলম মৌলভীর সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। পুলিশ এ ঘটনায় তাদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে মিথ্যা মাদক মামলায় আমার স্বামীকে ফাঁসিয়েছে। তারা মধ্যরাতে এসে বাড়ির দরজা ভেঙে আমার স্বামীকে কিছু না বলেই ধরে নিয়ে গেছে। ওই সময় আমার ছোট ছোট সন্তানরা কান্না করছিল। এরপরও পুলিশ এক মিনিটও আমার স্বামীকে সময় দেয়নি। কলমুডাঙ্গা পূর্ব পাড়া জামে মসজিদের খতিব মাওলানা রমজান আলী বলেন, মামুন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছেলে। তাকে কখনো কোনো প্রকার মাদক সেবন করতে দেখিনি। নিরপরাধ একটি ছেলেকে কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করেছে।
চৌমুহনী বাজারের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী পারভেজ বলেন, আমার দোকানে মোবাইলের বৈধ কাগজপত্র থাকার পরেও এএসআই রেজোয়ান দোকান থেকে ২১টি মোবাইল ফোনসহ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ১১টি চোরাই মোবাইল ফোন উদ্ধার দেখিয়ে ১০টি গায়েব করে দেয় এবং সেই মামলায় আমাকে জেল হাজতে পাঠায়। ওসি আজিজ এবং রেজোয়ান সিন্ডিকেট এলাকায় নিরীহ মানুষদের হয়রানি এবং মামলা বাণিজ্য করে খাচ্ছে বলে অভিযোগ তার।
কলমুডাঙ্গা মানব কল্যাণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি জিয়াউর রহমান মাস্টার বলেন, ওসি আব্দুল আজিজ সাপাহারে যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন নিরপরাধ মানুষকে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে মামলা বাণিজ্য করে যাচ্ছে। মামুন একজন নিরপরাধ এবং ভালো ছেলে, সে কখনই মাদকের সঙ্গে জড়িত হতে পারে না। তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমরা মামুনের নিঃশর্ত মুক্তি চাই।
সাপাহারের স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশা ছিল ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর অনেক কিছুই বদলাবে। কিন্তু কিছুই বদলায়নি। এই ওসি যোগদানের পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে গড়ে তোলেন একটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা গ্রেফতার ও মামলা বাণিজ্য করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আগে একদল থানা নিয়ন্ত্রণ করত, এখন করছে আরেক দল। প্রকৃত পুলিশি সেবা পাচ্ছে না সাধারণ জনগণ। পুলিশ সংস্কার করে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ, নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের সুরক্ষা; পুলিশ ও জনগণের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ করেছেন তারা।
অভিযোগের ব্যাপারে মুঠোফোনে নওগাঁর সাপাহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল আজিজ বলেন, এগুলো একেবারেই মিথ্যা ও বানোয়াট। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করছে। এ রকম কোনো বাণিজ্যের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয় বলে দাবি তার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁর সহকারী পুলিশ সুপার (সাপাহার সার্কেল) শ্যামলী রানী বর্মন বলেন, অনুসন্ধান চলছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ জুন দৈনিক খোলা কাগজ পত্রিকার শেষের পৃষ্ঠায় ‘উত্তরাঞ্চলে ওসিকাণ্ডে আলোচনায় পুলিশ’ শিরোনামে শীর্ষ সংবাদ প্রকাশিত হয়। খবরটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এরপর মামলা বাণিজ্যের অভিযোগে এবার আলোচনায় আসে সাপাহারের ওসি।
কেকে/এএম