ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর ২০২৪ | ১৮ আশ্বিন ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আদর্শিক রাজনীতি চর্চা আর দেশ উন্নয়নে প্রভাব

মাহবুব আলম প্রিয়
🕐 ২:৪৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৫, ২০২২

আদর্শিক রাজনীতি চর্চা আর দেশ উন্নয়নে প্রভাব

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ব্যক্তিচর্চা রাজনীতির আদর্শিক গণতান্ত্রিক চেতনার পরিবেশ যেন বিলীনের পথে।দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে আদর্শিক চর্চাও কমে গেছে। অথচ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সহনশীল ও পরস্পরের সহযোগিতামুলক রাজনৈতিক অবস্থান। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শিক কোন চিহ্ন আহকাল দেখা যায় না। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে তৃনমুল পর্যায় রাজনৈতিক সহাবস্থান চোখে পড়ে না। দলগত বিভাজন আর পাল্টাপাল্টি সমালোচনা, শত্রুতা, মামলা হামলায় তৈরী সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধ।

সূত্রমতে, বিগত দিনে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে গড়ে তুললেন বিএনপি৷ এরশাদ গড়ে তুললেন জাতীয় পার্টি৷ বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী খন্দকার মুশতাকও কয়েক মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়ে গড়ে তুলেন ডেমোক্রেটিক লীগ নামের একটি সংগঠন৷ ক্ষমতার বলয়ে থাকার সময়ে এসব সংগঠনে ডান বাম সর্বস্তর হতেই নেতাকর্মী যোগদানের হিড়িক পড়ে যায়৷ বাস্তবে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের জন্য কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও জীবনমানের উন্নতিতে সন্তোষজনক মনে করেননা খোঁদ দেশের নাগরিক সমাজ।

রাজনীতির বর্তমান চিত্র দেখলে ও দেশের মিডিয়াগুলোর সংবাদ সূত্রমতে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় শ্লোগান দেয়া দলগুলোতেই তা মানতে দেখা যায় না ৷ এখন তা উল্টে হয়ে যাচ্ছে। দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় চিত্রই আমরা দেখছি।

পদের লোভে, ক্ষমতার লোভে তোয়াজ আর তেলমর্দনে ক্রমশই জনগণের কাছে পিচ্ছিল হয়ে উঠছে। এখন টাকা হলে দেশের মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়। টাকা হলেই সংগঠনের নেতা হওয়া যায়। আর ক্ষমতাসীনদের ঘিরে গড়ে উঠছে একশ্রেণির তোয়াজকারী ও চাটুকার চক্র৷ রাজনীতি হয়ে উঠছে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও উপার্জনের পথ৷ চলছে পদ-পদবী বেচাকেনা৷ নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য প্রভৃতি রাহুর মত ঢেকে দিচ্ছে রাজনীতির জনহিতৈষী আদর্শিক চেতনাকে৷

আবার দলের নিবেদিত কর্মীর সংকটও দেখি। যেমন গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় না থাকাতে দু চারজন ত্যাগি নেতা কর্মী ছাড়া কাউকে জোর গলায় বলতে শুনা যায়না যে সে বিএনপি করে। অপরদিকে ক্ষমতাসীনদের কাছে যোগ দিচ্ছে সুবিধাবাদীরা। কিন্তু বিএনপি আবার ক্ষমতায় গেলে কি তারা ফের নিজ দলে ফিরবে? তারা চলে যাবে সামনের সারিতে আর দুর্দিনে লেগে পড়ে থাকারা পড়ে যাবে পেছনের কাতারে৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনটিই চলছে।

বর্তমান ক্ষমতাসীনরা দাবী করেন, বিএনপি-জামাতের ৪ দলীয় জোট সরকারের দমনপীড়নের সময়ে রাজপথে নির্যাতিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা৷ এছাড়া কারাবরণ করেছে হাজার হাজার নেতাকর্মী৷ একুশে আগস্টে গ্রেনেড হামলায় যেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তখনো শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে মানব ঢাল হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই৷ যদিও এসব ঘটনায় নিবেদিত কর্মীরা ছিলেন সরব।

আদর্শিক রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম। তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোনদিকে যায়, তার প্রতি মানুষের নজর থাকে। আমার দেশ, তোমার দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর; এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে মূলত দেশপ্রেম প্রকাশ করাটা জরুরি নয়। যে দেশপ্রেম অন্য জাতিকে হেয় করে, তা উৎকট স্বাদেশিকতা এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে তা আদর্শিক রাজনৈতি নয়। জাপানিদের উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তাদের দেশপ্রেম জাতীয় অহংকারে পরিণত হয়েছে।

উদাহরন সরূপ বলতে পারি, মানসম্মত পণ্য এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জাপানি দেশপ্রেমের নিদর্শন। তারা সবক্ষেত্রেই দেশকে বড় করে দেখেছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই নিজের দেশের চাইতে ব্যক্তিকে বা নিজকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আবার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা। তাই নেতৃত্বে আদর্শের ছোঁয়া না থাকলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্যোগ ও সংকট।

বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্বে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা। প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা এই টাকাওয়ালাদের কাছে এক ধরনের জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করে পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন; তৈরি করলেন অগণিত নেতাকর্মী । কিন্তু দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে বসলেন।

অথচ ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের গৌরবময় অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছিল দেশের মানুষের রাজনৈতিক বোধ আর সক্রিয়তার কারণেই। আর তার জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময় দেশ পেয়েছিল বিচক্ষণ আর কর্তব্যনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ যথাযথ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল অনেক ছাত্রনেতা।

গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, রাষ্ট্র শাসনের কাজে যুক্ত হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যাদের মধ্যে এই গুরুদায়িত্ব পালনের সহজাত যোগ্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য দেখা যাবে, সেই মানুষের বিশেষ রাজনৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। যে রাজনৈতিক শিক্ষা তাদের শেখাবে বিত্ত এবং ক্ষমতা লাভ করলেই জীবন অর্থবহ হয় না। প্রকৃত অর্থে সুন্দর জীবন হলো, প্রজ্ঞা, শুভবোধ ও ন্যায়বিচার দিয়ে পরিচালিত জীবন।

রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালনের মানসিকতা। কিন্তু আমাদের চারপাশে নেতাকর্মীদের যোগ্যতা কি দেখি? দেখি, যার টাকা আছে, যার টাকা দিয়ে সভাসমাবেশে ভাড়ায় লোক সমাগমের সামর্থ আছে, চাপার জোড় বা মিথ্যে প্রতিশ্রুতির মতো প্রতারনা অভিযোগ আছে, জবর দখলের মতো ক্ষমতা আছে, তাদের দল টেনে নিয়ে নেতা তৈরী করে দিচ্ছে। এতে সাধারন জনগণের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। রাজনীতি নাম শুনলেই মুখ ফিরিয়ে নেন তারা।

রাষ্ট্র হলো একটি গাড়ি আর দেশের শাসক গাড়ির একটি চাকা। গাড়ির অন্য চাকাগুলো হলো দেশের মন্ত্রীরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক চাকায় যেমন গাড়ি চলবে না; তেমনি মন্ত্রীরা রাজনীতি-অভিজ্ঞ ও সুবিবেচক না হলে শাসক একা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না। রাজনীতি করলে, জনপ্রতিনিধি হলে যে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে দূরে থেকে সত্যিকার অর্থেই মানুষের সেবা করতে হবে। রাজনীতি করা, সংসদে দায়িত্ব পালন করা সহজ কোনো কাজ নয় যে, প্রকৃত রাজনীতির প্রয়োজনীয় পাঠ এবং চর্চা ছাড়া এবং জটিল দায়িত্ব পালনের মতো বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া যে কেউ রাজনীতিবিদ হয়ে যাবেন।

সৎভাবে জীবনযাপন করা কেন জরুরি, তা বোঝার জ্ঞান যে রাষ্ট্রে মানুষের তৈরি হয় না, সেই রাষ্ট্র একটি নির্বোধ রাষ্ট্র। আর যে রাষ্ট্রে মানুষ জানে ন্যায় আর সততা কী, কিন্তু জানার পরও তারা সৎভাবে জীবনযাপন না করে অন্যায় কাজ করে, সেই রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিকৃত চিন্তার রাষ্ট্র।

দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে যেভাবে বিভিন্ন সময় দুর্নীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ ব্যবসা, অনিয়ম, রাজনৈতিক ক্ষমতায় মত্ত হয়ে সন্ত্রাস আর নির্যাতনের চিত্র আমরা দেখি। রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি হয় জনকল্যাণ, তাহলে রাজনীতি করে সম্পদশালী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাইকে সুখে রেখেই নিজের উন্নয়ন সম্ভব ছিলো। যা লোভের বশবতি হয়ে অনেক রাজনৈতিক নামধারীরা নিজের আখের গুছিয়েছেন।

অথচ আমাদের সমাজে দুর্নীতি হচ্ছেই। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ যদি এই দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হন, তাহলে জনগণের কল্যাণের জন্য তারা কাজ করছে কোথায়? এখানে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। মূল দলের কোনো নেতার কর্মকান্ড বিতর্কিত হলেও ছাত্র সংগঠন তার সমালোচনা করে না। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এমন রাজনৈতিক চর্চায় অভ্যস্ত হওয়ায় আদর্শের চর্চা হয় না।।

রাজনীতিবিদরা তাই তখনই সফল, যখন তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে কর্তৃত্ব করার পরিবর্তে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেন। হারজেন সতর্ক করে ছিলেন যে, কিছু রাজনীতিবিদ কেবল নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করেন, জনসাধারণের অবস্থার পরিবর্তন করার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকে না। তারা নিজেদের সুবিধার জন্য ঠিকই টিকিয়ে রাখেন এবং গণমানুষের প্রকৃত মুক্তি আসে না। রাজনীতি যদি একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তাহলে তা আর রাজনীতি থাকে না। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি কেবল মুখের কথায় নয়, সত্যিকার অর্থেই কি সাধারণ মানুষের কল্যাণ করছে? রাজনীতি যারা করেন তাদের এবং সচেতন নাগরিকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটাতে হবে।

নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় করাকে অবাস্তব দেশপ্রেম বলা হয়। এই গ্রহের অংশীদার হিসেবে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনি যা করবেন, তা আমাকে প্রভাবিত করবে এবং আমার কাজ আপনার ওপর বর্তাবে; এ কারণেই পারস্পরিক সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যায়নের ওপর প্রতিটি দেশের কাঠামো প্রস্তুত হয়। রাজনীতিতে শেষ বলে কথা নেই এ ধরনের ধোঁকাবাজি, নীতিহীন ও স্বার্থবাদিতার কথা যারা বলেন, মূলত তারাই সুস্থ রাজনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তরুণ মেধাবী শ্রেণি তাদের এই কূটকথা বোঝে বলেই রাজনীতিবিমুখ এবং অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। এটা কোনোভাবেই দেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।

তাই এমন পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি। শিক্ষিত তরুণদের মানসিকতা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলোর উপলব্ধি করা এখন সময়ের দাবি। তাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যাদের ওপর নির্ভরশীল এবং যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা রাখে, সেই শিক্ষিত ও যোগ্য তরুণ শ্রেণিকে দেশের সম্পদ ভেবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে স্বার্থবাদের রাজনীতি চলছে, তা দেশে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। উৎসর্গ মানে সব সময় হারানো নয়, বরঞ্চ বেছে নেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো, বৃহত্তর অর্জনের জন্য ক্ষুদ্রতর বিসর্জন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে আমরা হতে পারতাম স্বার্থক জাতি।

লেখক- সাংবাদিক

 
Electronic Paper