ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৬ ভাদ্র ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চিকিৎসা পাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী

উন্নয়ন ভাবনা থেকে বাজেট

জাফর আহমদ
🕐 ৩:০৪ অপরাহ্ণ, জুন ১৩, ২০২১

উন্নয়ন ভাবনা থেকে বাজেট

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, বাজেটকে বলা হয় সামনের বছরের বা কোনো নির্দিষ্ট বছরের হিসাবপত্র। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাজেটের মধ্য দিয়ে সুদূরপ্রসারী ভিশন সামনে রেখে এই বছরের পরিকল্পনা করা হয়। সেটা রাজস্ব পরিকল্পনাতে আছে, আবার উন্নয়ন পরিকল্পনাতেও আছে। এখন তুমি যেটা বললে সেটা রাজস্ব পরিকল্পনা। রাজস্ব পরিকল্পনায় এমন কিছু ছাড় দেওয়া হচ্ছে ১০ বছরের যে কর অবকাশ দেওয়া হচ্ছে সেখানে স্বাস্থ্য খাতে যে বিকেন্দ্রীয়করণ ও এটা একটি যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের জেলা ও উপজেলা বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। এমনকি যে সব জেনারেলাইজ হাসপাতাল আছে সেখানে আর্থিক সংগতি নেই। সুতরাং সেখানে যদি ব্যক্তি খাতে এ ধরনের হাসপাতাল গড়ে ওঠে সেটা ভালো। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও সমমানের করা উচিত। শুধুমাত্র ব্যক্তি খাতের ওপর স্বাস্থ্য খাত ছেড়ে দিলে দেশের জন্য বা মানুষের জন্য ভালো হয় না। মূল কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকে। জেলা হাসপাতাল আছে, উপজেলা হাসপাতাল আছে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কমিউনিটি কেন্দ্র আছে- এগুলোকেও আধুনিক করতে হবে।

গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যেতে সময় লাগবে। কিন্তু এখনি জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে, আধুনিক করতে হবে। বিশেষ করে এখন জেলা পর্যায়ে কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে। আমাদের হাসপাতালের সেন্টাল অক্সিজেন প্লান্ট, ভেন্টিলেশন এবং আরও কারিগরি যে সব সাপোর্ট থাকা প্রয়োজন আছে সেগুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এগুলো কোনো দেরি ছাড়াই এগুলো দ্রুততার সঙ্গে করে ফেলা উচিত। প্রধানমন্ত্রী গত বছরই বলেছিলেন জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে যত রকমের আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে সব সুবিধা প্রয়োজন- অক্সিজেন থেকে শুরু করে সবগুলো নিশ্চিত করতে হবে। এ সব হাসপাতাল কিন্তু খুব বেশি আধুনিক হয়নি। সেই সব হাসপাতালগুলোকে আধুনিক করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের যে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে সেগুলোও কাজে লাগাতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি মিলেই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুতরাং দুই দিকেই উন্নতি করতে হবে। জেলা পর্যায়ে ২০০ বেড পর্যন্ত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় ১০ বছর পর্যন্ত কর অবকাশ প্রস্তাব করা হয়েছে। সারা দেশে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব কতটা ভূমিকা রাখবে-খোলা কাগজের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

আতিউর রহমান বলেন, এই বাংলাদেশ তো থাকবে না, বাংলাদেশ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু হয়ে যাচ্ছে। মাত্র বিয়াল্লিশ মিনিটে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌঁছানো যাবে। দুই ঘণ্টার মধ্যে খুলনা পৌঁছানো যাবে। সুতরাং গ্রাম আর গ্রাম থাকবে না। সেখানেও জীবনের মান অনেক উন্নত হবে। সুতরাং স্বাস্থ্যসেবা বিকেন্দ্রীকরণ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। অনেক জেলাতে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় চলে গেছে। ভালো স্কুলেরও ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে ছেলে-মেয়েদের ভালো স্কুলে পড়াতে ঢাকাতে ভিড় না করে। আগে যেমন জেলা স্কুল ছিল-মহাকুমা স্কুল ছিল, ও রকম বেশি সংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে ডাক্তার বলি, অন্যান্য পেশাজীবী বলি তাদের সন্তানদের ওই সব স্কুলে ভর্তি করবে, অন্যরাও যারা ঢাকামুখী হচ্ছে তারা জেলা পর্যায়ের ওই সব স্কুলে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করবে। এখন অনেকে এমন আছে নিজে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে থাকে আর ছেলে-মেয়েদের ঢাকাতে ভর্তি করেছে। যেখানে তাদের মনোযোগ রাখতে হয়। ডেপুটি কমিশনাররা তাদের সন্তানদের ঢাকায় রাখে। আগের দিনের ডেপুটি কমিশনাররা তা রাখতেন না। কর্মস্থলেই সে রকম স্কুল ছিল। ওখানেই ওই রকম স্কুল আমাদের করতে হবে। এই জায়গাগুলোতে আমাদের কাজ করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জেলা উপজেলা পর্যায়ে উন্নত করতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। প্রাইভেট যদি আসে তাহলে তো আরও ভালো হবে। পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হলে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। এ সব অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকায় ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। এই যোগাযোগ শুধু কিন্তু দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের হয়ে তা নয়। যেমন ধরো ময়মনসিংহের সড়কে ফোর লেন হয়েছে, চট্টগ্রামের হয়ে গেছে, উত্তরাঞ্চলের উন্নতি হয়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গেও যোগাযোগের উন্নতি হচ্ছে। সেদিকে থেকে পুরো বাংলাদেশই একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আসছে। সুতরাং আমার মনে হয় সারা বাংলাদেশটাই সিঙ্গাপুরের মতো একটা আধুনিক দেশ গড়বার প্রস্তুতি চলছে।
যে সব কৃষক পণ্য উৎপাদন করছে তার মূল্য পাওয়ার নির্ভর করছে তার দ্রুত বাজারজাত ও ন্যায্য মূল্য পাওয়ার ওপর। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে আমুল পরিবর্তন এসেছে। কৃষক যে পণ্য উৎপাদন করছে তা দিনের মধ্যে ঢাকায় চলে আসছে। এখন কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছে।

এরই মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনও তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। সরকারের গ্রামে শহরের সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভীষ্ট নির্ধারণ নির্ধারিত আছে। মফস্বলে স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেটে যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছেÑ এ সব উদ্যোগ তারই অংশ কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সাবেক গভর্নর বলেন, হ্যাঁ এর সঙ্গে শিল্পাঞ্চলও তৈরি হচ্ছে। শিল্পাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু শুধু শিল্পাঞ্চল হলেই হবে না। শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে বেশকিছু বিষয় যুক্ত আছে সেগুলোর উন্নয়ন করতে হবে। যেমন ধরেন, শিল্পাঞ্চলের মালামাল বন্দরে আনা-নেওয়ার জন্য সড়কের প্রয়োজন, বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজন। শিল্পাঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য আবাসন প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। যদি এগুলো নিশ্চিত করা যায় তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ হবে এবং এখানেই থাকবে। যদি এ সব সুবিধা নিশ্চিত করা না যায় তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেও থাকতে চাইবে না। সে জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে যে কাজগুলো করা হচ্ছে সেগুলো একটি সূদরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে করা হচ্ছে।

শুধু এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে নয়, গত কয়েক বছরের বাজেট লক্ষ্য করি দেখা যাবে একটি সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য নিয়ে বাজেট করা হচ্ছে। আমাদের অবকাঠামো খাত- জ¦ালানি উন্নয়ন করা যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ হওয়া উচিত এবং গুণমানের বিনিয়োগ হওয়া উচিত। বিনিয়োগ হলে ভালো মানের শিক্ষা ব্যবস্থা করা যাবে, ভালো মানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে। জনশক্তি উন্নয়নের জন্যই এগুলো দরকার তিনি যোগ করেন।

এই যে বলছেন এসডিও বা মফস্বলে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা জেলা পর্যায়েই তাদের সন্তানদের রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। এমনকি স্বাস্থ্যসেবার জন্যও বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলে জেলা পর্যায়েই প্রয়োজন মেটানো হতো। জেলা বা উপজেলা সরকারি কর্মকর্তারা একমাত্র ঢাকাকেই বেছে নেওয়া শুরু করল এমন প্রশ্নের জবাবে আতিউর রহমান বলেন, স্বাধীন দেশ হলো। সকলেই ঢাকায় আসতে শুরু করল।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনা থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি আকাক্সক্ষা থেকে যুদ্ধ করে, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নিজেদের একটি দেশ হওয়ার পর সকলেই ঢাকা আসতে শুরু করল। ঢাকাকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সহ সকল কর্মকাণ্ড শুরু হলো; যখন তৈরি পোশাক কারখানাগুলোসহ বেসরকারি শিল্প কারখানা হতে লাগল, প্রচুর মানুষ গ্রাম থেকে ঢাকার দিকে রওনা দিল। কারণ কর্মসংস্থানগুলো ঢাকা ও তার আশপাশে হওয়া শুরু করল। বাংলাদেশের অর্থনীতির ষাট থেকে সত্তর ভাগ ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। সুতরাং এ রকম একটি জায়গায় এ রকম হবেই। তুমিই যেমন বললে সারা দেশে কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের কথা চিন্তা করে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এগুলো হয়ে গেলে খানিকটা ভারসাম্য হবে। যারা ঢাকার বাইরে আছে সেখানেই কর্ম পেলে তারা আর ঢাকামুখি হবে না।

যারা ঢাকাতে আছে তারাও চেষ্টা করবে নিজ গ্রামের কাছাকাছি থাকার। অর্থনীতি বেড়ে গেলে, সারা দেশে ছড়িয়ে গেলে প্রশাসন বিকেন্দ্রীয়করণ করতে পারলে, সেখানে যদি তাদের স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালও যদি উন্নতমানের করা যায়, তাহলে তখন মানুষ গ্রামে থাকবে, যারা ঢাকায় আছে তারা গ্রামে চলে যাবে- ঢাকায় থাকবে না। কারণ এই বাড়তি মানুষের চাপের কারণে ঢাকা তো থাকার জন্য ভালো থাকেনি। বসবাসের জন্য বিশ্বের চতুর্থ নিকৃষ্টতম শহর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সুতরাং বাইরে যদি সুযোগ করা যায় তাহলে মানুষ ঢাকা ছেড়ে বাইরে চলে যাবে।

যখন পদ্মা সেতু তৈরি হয়ে যাবে আমার ধারণা ফরিদপুরের ভাঙ্গায় একটি বড় শহর গড়ে উঠবে। অনেকে ভাঙ্গা থেকে এসে ঢাকাতে অফিস করবে। এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিক। পদ্মার পাটুরিয়া পয়েন্টে আরও একটি সেতু হোক। এক সময়ের সাংস্কৃতিক রাজধানী ও স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন রাজধানী কুষ্টিয়া ও আশপাশের জেলাগুলোকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ দ্রুত করার জন্য ইতোমধ্যে প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ হয়েছে। আগামীতে পদ্মার পাটুরিয়া পয়েন্টের সেতু নির্মাণের জন্য আরেক সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সুযোগ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হোক।

 
Electronic Paper