ফুটপাত থেকে পাবলিক টয়লেট, রক্ষা নেই কোনোটির। সব কিছুই দখল হয় রাজধানী শহর ঢাকায়। খাল, পুকুর, নদী সবখানেই দখলদারদের থাবা। সব মিলিয়ে ঢাকা যেন এক দখলের নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগর বিশ্লেষক আর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, দুই কোটি বাসিন্দার এ ঢাকা শহরে নাগরিকদের দেখার যেন কেউ নেই। দখলের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অনেকেই খুব প্রভাবশালী। তারা আইনকে পরোয়া করে না। আবার যারা আইন প্রয়োগ করবেন অনেক ক্ষেত্রে তাদের একটি অংশও এসব দখলে জড়িত বলে দখলমুক্ত কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এ শহরে ফুটপাত দখল একটি নিয়মিত ঘটনা। পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারেন না। অধিকাংশ ফুটপাত, বিশেষ করে মার্কেট এলাকার ফুটপাত পুরোটাই হকারদের দখলে। সেখানে তারা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। তবে দখলটা তারা করেন না, তারা আসল দখলদারদের ফুট হিসেবে ভাড়া দিয়ে তারপর দোকান নিয়ে বসেন। যে কারণে ঢাকায় ফুটপাতের জায়গা দখলকে বলে ‘ফুট ব্যবসা’।
দখল ঠেকাতে দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, রাজউক, পুলিশসহ আরো কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় পাবলিক টয়লেট আছে ১০১টি। এর মধ্যে দখল হয়ে গেছে ২৬টি। দখল হয়ে যাওয়া পাবলিক টয়লেট উদ্ধারে এখন আদালতে দৌড়াতে হচ্ছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে। এসব দখলের কথা সিটি করপোরেশনের রেকর্ডেই আছে। বাস্তবে দখলের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার এলাকায় পাবলিক টয়লেটের ওপর দুই তলা ভবন তৈরি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেখানে আবার করা হয়েছে স্থানীয় এক রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, নিচতলায় করা হয়েছে জুতার দোকান। সিটি করপোরেশন দখল হওয়া পাবলিক টয়লেটের যে হিসাব তৈরি করেছে তাতে দেখা যায়, ২৬টি পাবলিক টয়লেট তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। টয়লেটগুলো নিয়ে সিটি করপোরেশনের মামলার বিপরীতে পাল্টা মামলা করছে দখলদাররা।
নিউমার্কেট এলাকায় এক বর্গফুট ফুটপাতের জায়গার জন্য প্রতিদিন ১০০ টাকা দেন হকাররা। তবে জায়গাভেদে এর চেয়েও বেশি দিতে হয়। এই টাকা তোলার জন্য আছে লাইনম্যান। নিউমার্কেটসহ আরো অনেক এলাকার ফুটওভার ব্রিজও দখলে চলে গেছে। পথচারীরা ওই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে পারেন না বললেই চলে।
ঢাকার যাত্রীছাউনিগুলোও দখল হয়ে গেছে। যাত্রীছাউনিগুলোতে দোকান গড়ে উঠেছে। যাত্রীদের যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করার জায়গা নেই। বৃষ্টির সময়ে তারা পড়েন চরম দুর্ভোগে। নিউমার্কেট থেকে গাবতলী পর্যন্ত প্রতিটি যাত্রীছাউনিতে দোকান বসেছে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনেরই কিছু অসাধু কর্মকর্তা সেগুলো ভাড়া দিয়েছেন। এখন আবার সড়ক দ্বীপ আর রোড ডিভাইডার দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাফিক পুলিশ বক্স। তারা কোনো অনুমতির ধার ধারে না। যেখানে প্রয়োজন পুলিশ বক্স তৈরি করা হচ্ছে।
দুই সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে ১৬৩ কিলোমিটার ফুটপাতের মধ্যে ১০৮.৬০ কিলোমিটারই দখলে। এ ছাড়া নগরীর দুই হাজার ২৮৯.৬৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫৭২.৪২ কিলোমিটারে বসছে পণ্যের পসরা। শুধু গুলিস্তান ও এর আশপাশের এলাকায় ফুটপাত দখল করে কমপক্ষে এক হাজার ২০০ দোকান বসে। এসব দোকান থেকে সর্বনিম্ন ১০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণা অনুযায়ী, দুই সিটি করপোরেশনে ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে দুই হাজার ১৬০ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবি বলেন, ‘আমরা গুলিস্তানসহ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতকে রেড জোন ঘোষণা করেছি। এখন এগুলো দেখার দায়িত্ব অনেকের। সেখানে সশরীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আছেন। তাদের দায়িত্ব আছে। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আছেন, তাদের এলাকার ফুটপাতের ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কিছু কিছু দখল আছে, যা আমরা আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদের চেষ্টা করছি। আমরা আদালতে গিয়েছি। পাবলিক টয়লেটগুলো আমরা ইজারা দেই। এখন ইজারাদাররা সেখানে দোকান বসালে সব সময় আমাদের নজরে আসে না।’
বেদখল খেলার মাঠ ও পার্ক : ঢাকার খেলার মাঠ-পার্ক সবই দখলের শিকার হচ্ছে। ঢাকার সরকারি জমি দখল করে হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। কাগজে-কলমে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ২৩৫টি খেলার মাঠ আছে। কিন্তু বাস্তবে ওই মাঠগুলোর অধিকাংশই এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। গবেষণা বলছে, এর মধ্যে ৪২টি মাঠ এখন সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারছে। শতকরা হিসাবে এটা ১৮ ভাগ। তবে সিটি করপোরেশনের বাইরের মালিকানায়ও কিছু মাঠ আছে। সেই হিসাব ধরলে ৩০ ভাগ মাঠ এখনো ব্যবহার করা যায়। তবে বিভিন্ন মাঠ ক্লাবগুলোকে বরাদ্দ দেওয়ায় সেগুলো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারেন না বলে জানান পরিবেশ ও নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ হাইকোর্ট ঢাকা শহরের মাঠ ও পার্কের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, রাজউক এবং গণপূর্ত অধিদফতরকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক রিটের পর আদালত ওই নির্দেশ দেন।
বেলার রিট আবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আয়তন ৩০৫.৪৭ বর্গকিলোমিটার। আয়তন বিবেচনায় দুই সিটি করপোরেশনে খেলার মাঠ দরকার অন্তত ৬১০টি, রয়েছে মাত্র ২৩৫টি। সেগুলোরও অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ১২৯টি ওয়ার্ড থাকলেও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) উল্লেখ রয়েছে যে, ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডে পার্ক বা উদ্যান রয়েছে মাত্র ২৭টি। এর মধ্যে ৬টি পার্ক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডে পার্ক রয়েছে মাত্র ২৩টি। বিদ্যমান এসব পার্ক ও খেলার মাঠের অধিকাংশেই নেই সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘আমাদের অবৈধ স্থাপনা ও দখল উচ্ছেদ অভিযান চলছে। এটা চলামান থাকবে। আর উচ্ছেদের পর যাতে দখলদারা আবার ফিরে আসতে না পারে এবার সেটাও আমরা দেখবো।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ফুটপাতসহ আরো যা আছে তা দখলমুক্ত করার বড় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। এবার আমরা কোনো ছাড় দেব না।’
ডিএনসিসি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ৩০ আগস্ট ২৩ পর্যন্ত ২০ মাসে এক হাজার ৬৩৯টি অভিযান পরিচালনা করেছে। সেখানে অবৈধ অবকাঠামো ভাঙা, জেল-জরিমানাসহ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবস্থা। ডিএসসিসি ৭৯টি এলাকায় নিয়ম করে অভিযান চালালেও লাভ হয় না।
বিপন্ন নদী, পুকুর, খাল ও লেক : ঢাকার জলাধার, পুকুর, লেক, খাল আর নদীও দখলে বিপর্যস্ত। ডেল্টা রিচার্স সেন্টারের হিসাবে ঢাকায় সরকারি হিসাবে পুকুর, লেক ও বিল আছে ৩২৭টি। এর মধ্যে ২৪১টি পুকুর এবং বিল ও লেক ৮৬টি। তার মধ্যে ৯০ ভাগ পুকুরই ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পুকুরও আছে। ভরাট করে ওইসব পুকুরে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। আর মাত্র ১৩টি লেকের অস্তিত্ব আছে।
ঢাকায় এখনো কাগজে-কলমে ২১টি খাল আছে। ২০২০ সালেও ডেল্টা রিচার্স সেন্টার ঢাকায় ৭৩টি খালের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল। এখন যে ২১টি খালের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোও ভরাট ও দখলের মুখে আছে। অনেক খাল নামে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকায় কমপক্ষে মোট আয়তনের ১৫ ভাগ জলাধার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আছে পাঁচ ভাগের কম। আর সবুজ খোলা মাঠ, পার্ক থাকা দরকার ২৫ ভাগ। কিন্তু এখন পাঁচ ভাগের বেশি নেই। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ আর বালু নদী দখলের কারণে শীর্ণ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে আছে দূষণ। বুড়িগঙ্গার তীর থেকে প্রতিবছরই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু আবার তা দখল হয়ে যায়। হাইকোর্টের নির্দেশেও বেশ কয়েকবার অভিযান হয়েছে। ২০২৩ সালে কমপক্ষে ৫০০ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তারা আবার ফিরে এসেছে। তুরাগ নদী দখল করে শিল্প কারখানাও করা হয়েছে। ওই দখলদারদের মধ্যে একজন প্রয়াত এমপিসহ প্রভাবশালীরা রয়েছেন।’
এ নদী দখল উচ্ছেদের একাংশের দয়িত্ব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। তারা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর দখলদারদের উচ্ছেদে মাঝে মধ্যেই অভিযান পরিচালনা করে। নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমরা কোথাও কোথাও আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে আটকে যাই। আবার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাই। দখলদাররা আবার ফিরে এলে আমরা আবার অভিযান চালাই।’ তার দাবি, এখন নদী দখল আগের চেয়ে কমে গেছে।
দখল হচ্ছে সরকারি জমিও : ঢাকায় প্রচুর সরকারি জমিও প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। ঢাকার ৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ২১টি বিদ্যালয়ের জমি এবং চারটি বিদ্যালয়ের জমি দখল হয়ে গেছে। ঢাকা চিড়িয়াখানার সাত একর জমি অনেক বছর ধরেই প্রভাবশালীদের দখলে আছে। অন্যদিকে ঢাকায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তিন হাজার ৬০০ একর জমি ও প্লট অন্যদের দখলে আছে দীর্ঘদিন ধরে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকাকে সব ধরনের দখলমুক্ত রাখা অনেক বিভাগের কাজ। তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। আর কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। আর যাদের দখলমুক্ত করার দায়িত্ব তাদেরই কেউ কেউ এ দখলের সঙ্গে জড়িত। এর সঙ্গে আছেন রাজনৈতিক নেতারা।’ তিনি বলেন, ‘দখলে দূষণে এখন ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। এটা দেখার যেন কেউ নেই। নগরবাসীকে জিম্মি করে কেউ কেউ অর্থ আয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন।’
পরিবেশ ও নগর বিশেষজ্ঞ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এখানে সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব। তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর এ নগরীতে দখল দূষণমুক্ত করতে আমরা কোনো কাজ দেখিনি। তারা এখন ব্যস্ত ঢাকার আশপাশে নতুন শহর করতে। তাতে তাদের লাভ।’ তিনি বলেন, ‘এখন ফুটপাত দখল করে চলছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। নদী, খাল, সরকারি জমি সব দখল হয়ে যাচ্ছে। এটা দখলের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ বক্স বানানো হচ্ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই সড়ক দ্বীপ ও রোড ডিভাইডারে। এখন ডিজিটাল যুগ। চাঁদাবাজির প্রয়োজন না হলে রাস্তায় তো এত ট্রাফিক পুলিশ দরকার নেই। ডিজিটালি ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যায়।’
কেকে/এআর