অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন চ্যালেঞ্জে পড়েছে সৌরবিদ্যুৎ খাতের বিনিয়োগকারীরা। দরপত্রে বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না তারা, বিদেশি সংস্থাগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগ থেকে সরে যাচ্ছে। বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের দাবি, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিদ্যুৎ খাতে সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যারা কালো টাকার মালিক হয়েছেন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের পাইয়ে দিতেই দরপত্রে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসব শর্ত পূরণ করে দরপত্রে অংশ নেওয়া সম্ভব না। এর পেছনে শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে বলেও জানান তারা।
দরপত্রে শর্তের বিষয়ে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের এমন কয়েকটি শর্ত রয়েছে, যা বিদেশি কোম্পানি এবং দেশি বিনিয়োগকারীদের কার্যকরভাবে অংশগ্রহণে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সালিশের জন্য একটি নিরপেক্ষ স্থান নির্বাচন করা প্রথাগত। সিঙ্গাপুর, লন্ডন বা জেনেভার মতো স্থানগুলো সাধারণত তাদের সালিশবান্ধব পরিবেশের জন্য বেছে নেওয়া হয়। এ ছাড়া ইসিএ অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত বিপিডিবি প্রকল্পগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ঢাকায় সালিশ নির্দিষ্ট করার ধারা বিদেশি অর্থদাতাদের নিরুৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে পিডিবি শেষ পর্যন্ত বিদেশি সংস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সিঙ্গাপুরে সালিশ স্থান সংশোধন করতে সম্মত হয়। বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য একটি নিরপেক্ষ সালিশি স্থান নির্বাচন করা প্রয়োজন।
স্থানীয় মুদ্রায় ট্যারিফ পেমেন্টের বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক দরপত্র, তাই বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বিদেশি অর্থায়নের ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থ প্রদান বিনিয়োগকারী, সরবরহাকারী এবং অন্যান্য অংশীজনদের কাছে তহবিল ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এ সীমাদ্ধতা আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের কাছে দরপত্রের আবেদনকে দুর্বল করে। এজন্য আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে ডলার অথবা ইউরো এর মতো রূপান্তরযোগ্য মুদ্রায় অর্থপ্রদান বা মুদ্রা বিনিময়ের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়া বিল পরিশোধের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। বিল জমা দেওয়ার ৬০ কার্যদিবসের মধ্য পরিশোধ করতে না পারলে, মোট বিলের ওপর সারচার্জ প্রদান করবে, যা বিদ্যমান বাজারের সুদের হারের তুলনায় অনেক কম।
আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে দরপত্রের আকর্ষণ বাড়াতে এসব বিষয়গুলো পুনঃবিবেচনা করা প্রয়োজন। এতে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে অবদান রাখার সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন তারা।
এ ছাড়া প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৩ একর জমি প্রয়োজন। এ হিসাবে ৩০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজন ৯০ একর বা ২৭০ বিঘা জমি। তবে এ জমির পুরোটাই হতে হবে অকৃষি। এ শর্তের কারণে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া কঠিন হবে।
যেসব স্থানে নির্মাণ হবে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র : ২০২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর ১২ স্থানে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এসব সৌরবিদ্যুকেন্দ্রের মধ্যে নোয়াখালীর সুধারাম উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৮ মেগাওয়াট, নীলফামারীর সবুজপাড়া উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২০ মেগাওয়াট, মৌলভীবাজার উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২৫ মেগাওয়াট, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২৫ মেগাওয়াট, বাঙামাটির চন্দ্রঘোণা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ২৫ মেগাওয়াট, কক্সবাজারের টেকনাফ উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৩০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামের লোহাগড়া উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৩০ মেগাওয়াট, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৩৫ মেগাওয়াট, কুড়িগ্রাম উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৪৫ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৪৫ মেগাওয়াট এবং ময়মনসিংহের ভালুকা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৪৫ মেগাওয়াট।
এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৮ জানুয়ারি ১০টি পৃথক স্থানে আরো ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করেছে বিপিডিবি। এসব সৌরবিদ্যুকেন্দ্রের মধ্যে কক্সবাজার উত্তর উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, কক্সবাজার উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, গোপালগঞ্জ উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, চুয়াডাঙ্গা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, নীলফামারীর জলঢাকা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, পঞ্চগড় উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, ফরিদপুর উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, হবিগঞ্জের বিবিয়ানা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট এবং হবিগঞ্জে মাধবপুরের শাহজিবাজার উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০ মেগাওয়াট।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, শর্ত অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠানের হাতে জমি আছে, তারাই দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই। সে হিসেবে বিগত সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠানই এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করার জন্য জমি ক্রয় করে রেখেছে। এ সময়ের মধ্যে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান জমি ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি খুলতে অনেক সময় লাগে। নিয়মানুযায়ী প্রক্রিয়া করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানবিশেষে এক বছরও লেগে যায়। ফলে এ দরপত্রে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং বিগত সরকারের সময়ে অনুমতি পাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোই অংশ নিতে পারবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খানিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে তথ্যানুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা ও এ খাতে অধিকতর সক্ষমতা, গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০২৪ সালের ২৫ আগস্ট পাবলিক পলিসি বিশেষজ্ঞ আব্দুল হালিম, ক্রয়সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মো. ফারুক হোসেন, আর্থিক মডেলিং বিশেষজ্ঞ তোহা মুহাম্মদ এবং আইন বিশেষজ্ঞ এস এম ফরমানুল ইসলামকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির নির্দেশনায় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের দরপত্রের শর্ত তৈরি করা হয়েছে। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের দাবি যারা ওই কমিটিতে আছেন তাদের কেউই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ নয়। ফলে তারা যে শর্তগুলো দিয়ে দরপত্র আহ্বান করেছে সেখানে আওয়ামী লীগের সময়ে সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া অন্যদের এ দরপত্রের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক সৌর কোম্পানি ইনফ্রাকো এশিয়ার উপদেষ্টা সাকির আহমেদ বলেন, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম শর্ত জমি ক্রয় করতে হবে। আগে পতিত জমি সর্বোচ্চ ৬ লাখ টাকা একর পাওয়া যেত। এখন বিক্রেতারা একর প্রতি ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা চাচ্ছে। ৫০ মেগাওয়াটের একটা প্লান্ট করতে গেলে ৫০ থেকে ৬০ কোটি নগদ টাকা শুধু জমি কেনার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। আগে এ ধরনের প্লান্টে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা হলেও হতো। ব্যাংক অর্থায়ন দেবে না। এ দরপত্রটি মূলত যাদের কালো টাকা আছে তাদের জন্য।
তিনি বলেন, দরপত্রে যে ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। তাতে বিদেশিরা নিরুৎসাহিত হবে। এ শর্তে বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করতে আসবে না।
স্থানীয় বিদ্যুৎ উদ্যোক্তা, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম বলেছেন, সরকারি সহায়তার নিশ্চয়তা ছাড়া বিনিয়োগকারীরা কীভাবে বিপিডিবিকে বিশ্বাস করবে, যারা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার দায় নিয়ে লড়াই করছে?
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেছেন, ঋণদাতারা বিপিডিবির ভঙ্গুর ব্যালেন্স শিট সম্পর্কে সতর্ক, কারণ প্রতিষ্ঠানটি বছরে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান করছে। শুধু সরকারি গ্যারান্টিই বিনিয়োগকারীদের এবং ঋণদাতাদের আকৃষ্ট করতে পারে।
বিদ্যুৎ খাতের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ক্রয়সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিনিয়োগকারীরা যেসব শর্ত চায়, সেগুলো পাবলিক প্রকিউরমেন্টে দেওয়া যায় না। আগে বিশেষ আইন ছিল যা ইচ্ছা তাই দেওয়া যেত, সেজন্য তাদের কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা গ্যারান্টি চায়, সরকার আলাদা করে কোনো গ্যারান্টি দেয় না, কারণ চুক্তিটাই একটা গ্যারান্টি। এখানে আলাদা করে গ্যারান্টি দেওয়ার প্রয়োজন নেই, এটা সম্ভব না।
তিনি বলেন, পিডিবি টাকা দিতে পারবে না, এই কথা উঠবে কেন। কোনো সরকারি অফিস যখন ক্রয় করে, তখন তার বাজেটে টাকা আনা তার দায়িত্ব, পে করা তার দায়িত্ব। যিনি দরপত্রে অংশ নিবেন, তার জানার দরকার নেই, টাকা আছে কি নাই।
মো. ফারুক হোসেন বলেন, বিনিয়োগকারীদের বলছে আরবিটেশন অ্যাক্ট এবং ভ্যানু সিঙ্গাপুর দিতে হবে। তাদের মতে বাংলাদেশে আরবিটেশন ভ্যানু ও বাংলাদেশি অ্যাক্ট বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস করে না। কিন্তু বাংলাদেশের সব দরপত্র রিভিউ করে দেখেছি, কেউই কোনো ক্ষেত্রেই অন্য কোনো আইন ব্যবহার করছে না। যখন এটা স্টিরিট হবে তখন বাংলাদেশি টিমকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। এটা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনেক ব্যয়বহুল এবং কঠিন। সেজন্য এটা মানা যাচ্ছে না।
এ বিশেষজ্ঞ আরো জানান, এক ফসলি জমিকে অকৃষি হিসেবে বিবেচনা করে সোলারপ্ল্যাট সেখানে করতে পারি কি না এ নিয়ে আমরা অর্থ, কৃষি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ে সঙ্গে আবার মিটিং করব।
তিনি বলেন, যারা আগে থেকে জমি ক্রয় করে রেখেছে সেতো একটু এগিয়ে থাকবেই, তার অর্থ এই নয় যে সে কাজ পেয়ে যাবে। সে যে ট্যারিফ অফার করবে এটা হবে প্রতিযোগিতামূলক। নিশ্চিত করে বলা যাবে না আগের ওই ব্যক্তিই পাবে। হয়তো কেউ কেউ পাবে, কেউ কেউ পাবে না। আমরা ধরণা করছে পারছি যে, ওরা আগে থেকে প্রস্তুত ছিল বলে ওরা দরপত্র প্রক্রিয়াতে এগিয়ে থাকবে। আমরা সুযোগ রেখেছি নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আসতে পারে। দরপত্রে শর্ত যত বেশি সহজ করা যায়, সব করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস