বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫,
৩০ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: রোগীর ‘গলা কেটে’ ডাক্তারের উপহার      পরিচয় লুকিয়ে আন্দোলন উসকাচ্ছে পতিত শক্তি      আজ থেকে শুরু বিএনপির দেশব্যাপী সমাবেশ      বাজছে নির্বাচনি দামামা      আকাশপথের ভাড়া নিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারি      নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছে সরকার: আসিফ মাহমুদ      সব্যসাচী স্টলে আক্রমণের নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে ২০৫ নাগরিকের বিবৃতি      
মুক্তমত
পোশাক নয়, সংস্কার হোক পুলিশি শুদ্ধাচার
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫, ৩:৪৮ পিএম  (ভিজিটর : ১৪৬)

বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের গরম গরম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক ও মতামত। তবে এ বিতর্কের মূলে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য— পোশাকের পরিবর্তন কোনো বাহিনীর কর্মক্ষমতা বা জনসেবার মানে সরাসরি পরিবর্তন আনে না। বরং বাহিনীর শুদ্ধাচার, মনোভাব এবং কার্যকর সংস্কারই পারে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে।

পুলিশ বাহিনীর পোশাকের বিবর্তন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকেই শুরু। সে সময় পুলিশ সদস্যদের জন্য খাকি রঙের পোশাক নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ রং নির্বাচন করা হয় সহজলভ্য রঞ্জক পদার্থ দিয়ে পোশাকের ময়লা ঢাকার সুবিধার্থে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও এ খাকি পোশাক ব্যবহার করতেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় পুলিশের পোশাকের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০০৪ সালে মহানগরের জন্য জলপাই রং এবং জেলা পুলিশের জন্য গাঢ় নীল রঙের পোশাক প্রবর্তন করা হয়। তবে এসব পরিবর্তন কেবল বাহ্যিক ছিল। পুলিশের নৈতিক আদর্শের কার্যকর কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। পুলিশ সব সময় সরকারি দলের দোসর এবং সাধারণ নাগরিকের জন্য খলনায়কের খোলসে আবৃত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা জনগণের তীব্র ক্ষোভের কারণ হয়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা নিজেদের পোশাক পরে বাইরে বের হতেও ভয়ে থাকতেন, সংকোচবোধ করতেন। অনেকেই ট্রমার শিকার হন। এমন প্রেক্ষাপটে পোশাক পরিবর্তনের দাবি ওঠে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুলিশের নতুন পোশাক হবে ‘আয়রন’ রঙের। র‌্যাবের পোশাক হবে ‘অলিভ’ এবং আনসারের পোশাক হবে ‘গোল্ডেন হুইট’। এ পরিবর্তনের পেছনে বাহিনীর কর্মক্ষমতা বাড়ানোর থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাহ্যিক চেহারার পরিবর্তনে। এ পরিবর্তন কী পারবে পুলিশকে তাদের নৈতিক স্খলন থেকে ফেরাতে? তাদের যে জব ডেসক্রিপশন, সেই অনুযায়ী তাদের পরিভ্রান্তভাবে গড়ে ওঠা মানসিকতা থেকে ফিরিয়ে মূল শুদ্ধাচার নীতিতে তারা কি সত্যিই ফিরবে জনগণের বন্ধু হয়ে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুলিশ, র‌্যাব এবং আনসার বাহিনীর পোশাক পরিবর্তন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে মনে করেন, পোশাক পরিবর্তন বাহিনীর কার্যকারিতা বা জনসেবায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারবে না। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একে কসমেটিক পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পোশাক পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পোশাক পরিবর্তন করে দায়িত্ব পালনের মান উন্নত করা যাবে না।’

অন্যদিকে প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের মন্তব্য করেছেন, ‘পোশাক পরিবর্তনে অর্থ বিনিয়োগের বদলে প্রশিক্ষণ ও কাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিল।’ বাহিনীর কর্মক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা। সাবেক আইজিপি নুরুল হুদার মতে, ‘পোশাকের রং পরিবর্তন করলে বাহিনীর প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাহিনীর দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা নির্ভর করে তাদের প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা এবং কার্যকর নেতৃত্বের ওপর।’ নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী মনে করেন, পোশাক পরিবর্তন একটি বাহ্যিক পরিবর্তন। বাহিনীর ভেতরের সমস্যা সমাধান করতে হলে মূলত কোড অব কন্ডাক্ট, প্রশিক্ষণ এবং মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। এ দরকারি বিষয়গুলো কী সংস্কার কমিটির পরিকল্পনায় আছে? পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে নানা সময় আলোচনা হলেও তা কখনোই কার্যকর রূপ পায়নি। বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্ষমতা বাড়াতে দরকার মানসম্মত প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি। জনসেবার মান নিশ্চিত করতে পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘স্বভাব, চরিত্র, খাসলত পরিবর্তন না করে পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ হবে না। প্রকৃত সমস্যা রয়েছে সিস্টেমে।’ গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি মনে করেন, ‘পোশাক পরিবর্তন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আনবে না। পুলিশ বাহিনীর শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন।’

শুদ্ধাচার মানে কেবল বাহিনীর সদস্যদের সৎ এবং কর্মঠ হওয়া নয়; এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিও বটে। পুলিশের অভ্যন্তরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অমানবিক আচরণ বন্ধ করতে হলে শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশের ভেতরে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানবিক পুলিশিং নিশ্চিত করতে বিশেষ অভ্যন্তরীণ ইউনিট গঠন করা দরকার। প্রশিক্ষণ এবং মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের জনসেবার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাহিনীর একটি নতুন পরিচয় তৈরি হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে। বাহিনীর সদস্যদের মানসিক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার উন্নয়নে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া না হলে পোশাক পরিবর্তন কেবলমাত্র একটি লোক দেখানো উদ্যোগ হিসেবেই থেকে যাবে। পুলিশ বাহিনীর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন, তথ্যভান্ডারের উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতার বিকাশের মাধ্যমে প্রকৃত পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে সরকারের উচিত বাহিনীর শুদ্ধাচার ও কাঠামোগত সংস্কারে বিনিয়োগ করা।

বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে বাহিনীর কার্যকারিতা এবং জনসেবার মান বাড়াতে কেবল পোশাক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, প্রশিক্ষণ, এবং নৈতিকতার উন্নয়ন। জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়তে হলে শুদ্ধাচারের কোনো বিকল্প নেই। পোশাক নয়, বরং বাহিনীর ভেতরের চরিত্র এবং কাঠামোর উন্নয়নেই হতে পারে প্রকৃত পরিবর্তনের চাবিকাঠি।

লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

কনটেন্ট ক্রিয়েটর কাফির বাড়িতে আগুন, প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনের ডাক
রোগীর ‘গলা কেটে’ ডাক্তারের উপহার
পরিচয় লুকিয়ে আন্দোলন উসকাচ্ছে পতিত শক্তি
আজ থেকে শুরু বিএনপির দেশব্যাপী সমাবেশ
বাজছে নির্বাচনি দামামা

সর্বাধিক পঠিত

বাহুবলে ডেভিল হান্ট অভিযানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
বহিষ্কার হলেন অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আবিদ হাসান জজ মিয়া
ডেভিল হান্ট অভিযানে সিরাজগঞ্জে গ্রেফতার ১০
ছুটি কাটিয়ে আর কর্মস্থলে ফিরেনি এডিসি আখতার
সুন্দরগঞ্জ হাসপাতালে দীর্ঘদিন পর চালু হলো আল্ট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রে সেবা

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝