বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫,
৩০ মাঘ ১৪৩১
বাংলা English

বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
শিরোনাম: রোগীর ‘গলা কেটে’ ডাক্তারের উপহার      পরিচয় লুকিয়ে আন্দোলন উসকাচ্ছে পতিত শক্তি      আজ থেকে শুরু বিএনপির দেশব্যাপী সমাবেশ      বাজছে নির্বাচনি দামামা      আকাশপথের ভাড়া নিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র জারি      নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছে সরকার: আসিফ মাহমুদ      সব্যসাচী স্টলে আক্রমণের নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়ে ২০৫ নাগরিকের বিবৃতি      
মুক্তমত
গণগ্রন্থাগারের সম্প্রসারণ ও সাংস্কৃতিক জাগরণ
মকবুল আহমেদ
প্রকাশ: রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫, ৬:২৬ পিএম  (ভিজিটর : ২৪০)
মকবুল আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

মকবুল আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যূত্থানের পর রাষ্ট্রসংস্কার বা রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র পুনর্গঠনের দাবি প্রধান হয়ে উঠেছে। একই সাথে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মানের লক্ষ্যে রাষ্ট্র বিশেষজ্ঞগণ সমাজের সর্বস্তরে সাংস্কৃতিক তৎপরতা বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপের উপর জোর দিচ্ছেন। জনগণের মধ্যে সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিস্তারের নানান মাধ্যম রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হলো গণগ্রন্থাগার বা পাবলিক লাইব্রেরি। জনগণের মধ্যে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে যদি সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাতে চাই, তাহলে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে গণগ্রন্থাগারের সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই।

বর্তমানে জেলা ভিত্তিক একটি করে সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে যা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। বড় বড় শহরে কেন্দ্র থেকে দূরে বা শহরতলীতে যারা বসবাস করেন তাদের সহজে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত সেই একটিমাত্র লাইব্রেরি ব্যবহার করার সুযোগ হয়ে ওঠে না। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লোক বসবাস করেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, উপজেলায়। গ্রামের জনগণই দেশের প্রধান উৎপাদক শক্তি, গ্রামের জনগণই শহরকে সকল প্রকার রসদ যোগানোর প্রাণদাত্রী, তারাই মাতৃশক্তি। রাষ্ট্রের উচিত গ্রামের জনগণের মাঝে গণতন্ত্রের ধারনা, রাষ্ট্রের উন্নয়নের দিক-নির্দেশনা ও উৎপাদনের আধুনিক নির্দেশিকা সরবরাহ করে জনগণকে শক্তিশালী করা। জনগণকে আধুনিক জ্ঞানের ধারনায় আলোকিত করার প্রধান কেন্দ্রস্থল হতে পারে উপজেলা ও  ইউনিয়নভিত্তিক  গণগ্রন্থাগার।

আমরা এখানে জেলা সদর থেকে উপজেলা সদর এবং সকল ইউনিয়ন পর্যায়ে কীভাবে গণগ্রন্থাগার প্রসার ঘটিয়ে জ্ঞান ও তথ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সংস্কৃতির জাগরণ বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করা যায় তার একটি রূপরেখার প্রস্তাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

সরকার পরিচালিত গণগ্রন্থাগার


বর্তমানে সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি গণগ্রন্থাগারের বিদ্যমান পরিস্থিতি তার হদিশ নেওয়া যেতে পারে। গণগ্রন্থাগার অধিপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি অধিদপ্তর যার অধীনে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারসহ সারাদেশে ৭১টি সরকারি গণগ্রন্থাগার পরিচালিত হয়ে আসছে। জাতীয় গণগ্রন্থাগার ব্যতীত বর্তমানে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে একটি করে সরকারী গণগ্রন্থাগার এবং অন্যান্য জেলা শহরে সরকার পরিচালিত একটি করে সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। সাধারণত সেটি জেলা সদরে অবস্থিত। জেলা শহরটি আকারে ও জন বসতির সংখ্যায় ছোটো হোক বা বড় হোক, তাতে শুধু একটি সরকারি গণগ্রন্থাগারই রয়েছে। ওয়েবসাইটে দেখা যায়, উপজেলা পর্যায়ে শুধুমাত্র দুটি উপজেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। সেই দুটি গণগ্রন্থাগার জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জে অবস্থিত। শুধুমাত্র দুটি উপজেলায় কোন বিবেচনায় সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে তা জানা যায় না।

উল্লিখিত স্থানে যতো সংখ্যক সরকারী গণগ্রন্থাগার রয়েছে বলে জানা যায়, তার বাইরেও সারা দেশে অনেক গণগ্রন্থাগার বা গণপাঠাগার রয়েছে যা বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। সমাজের অনেক বিদ্যুৎসাহী ও হিতৈষী ব্যক্তিদের উদ্যোগে এই সব বেসরকারী গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এই সকল গণগ্রন্থাগারের মধ্যে অনেক গণপাঠাগার বর্তমানে পৃষ্ঠপোষতকতার অভাবে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে, নতুবা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিত সমাজের নানান স্তরে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত এই সকল বেরসকারী গণগ্রন্থাগারসমূহকে বাৎসরিক অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সচল, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত হয়ে চলতে পারার মতো সামর্থ্যবান করে তোলা। এ জন্যে সরকারের উচিত বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত গণগ্রন্থাগার নীতিমালাকে আরও শক্তিশালী করা।

জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে গণগ্রন্থাগার

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিভাগীয় শহরে ও জেলা সদরে একটি করে সরকারী গণগ্রন্থাগার রয়েছে। জেলা শহর ছোট-বড় নানা আকৃতির রয়েছে। কিন্তু ছোট শহরের জন্য যেমন একটিমাত্র সরকারী গণগ্রন্থাগার রয়েছে, তেমনি বড় শহরের জন্যও একটি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। যেমন চট্রগ্রাম শহরের আকার কোনো কোনো ছোটো জেলা শহরের চার-পাঁচগুণ। কিন্তু ছোট শহরের জনসংখ্যার তুলনায় কোনো বড় শহরের জনসংখ্যা তুলনা করলে বড় শহরে পাঁচটি গণগ্রন্থাগার প্রয়োজন হতে পারে। দেশের সকল নাগরিককে সমান মর্যাদায় গুরুত্ব দিতে গেলে সকল উপজেলা সদরে একটি করে ও সকল ইউনিয়ন সদরে সরকারীভাবে একটি করে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে পরিচালনা করা আবশ্যক। বলাই বাহুল্য, বিভাগীয় ও জেলা গণগ্রন্থাগার মহাফেজখানা (অৎপযরাব) মর্যাদায় যে গ্রন্থরাজি ও দলিলদস্তাবেজের সংগ্রহ থাকবে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সে রকম সংগ্রহ থাকার প্রয়োজন হবে না। আমরা নিচে আলোচনা করে দেখাবো কীভাবে সহজে উপজেলা সদরে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এর ফলে গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেশের সকল জনগণকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কর্মসূচি অবগত করানো এবং জনগণকে অব্যাহত শিক্ষার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে তার আত্মিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।

বর্তমানে দেশের জনগণের মধ্যে সাক্ষরতার হার এখন অনেক বেড়েছে। দেশের সর্বত্র অনেক শিশু দারিদ্রের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নানান শ্রেণি থেকে ঝরে পড়ে। তারা আর বিদ্যালয়ে ফিরে যায় না। গ্রামাঞ্চলে এ রকম পড়তে-জানা সাক্ষর ও স্বল্পসাক্ষর ব্যক্তির দারিদ্যের কারনে ও পড়ার সামগ্রীর অভাবে, ক্রমশ সাক্ষরতা-ক্ষমতার হ্রাস ও লোপ পেতে থাকে। উপজেলা সদরে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে জনগণের মধ্যে অর্জিত সাক্ষরতা-দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যায়। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসাধারণের মধ্যে প্রচুর দরিদ্র সাক্ষর লোক রয়েছে, যারা গ্রামাঞ্চলে পড়ার সামগ্রীর অভাবে, পড়ার সুযোগের অভাবে, কিছু পড়তে পারে না। শহরের লোকেরা যে রকম সহজে দৈনিকপত্র-পত্রিকা, বইপুস্তক পড়ার জন্য পায়, গ্রামের লোকদের জন্য তা দুর্লভ। এতে গ্রামের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সাক্ষর লোকের পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে না। নিয়মিত দৈনিকপত্রিকা পঠনপাঠন, দৈনন্দিন ব্যবহারিক জ্ঞানের উন্নয়নমূলক লেখার পাঠ গ্রহণ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নের নীতি-নির্দেশিকা ও সাহিত্যপাঠ থেকে বঞ্চিত থেকে তারা যুগপৎ আত্মিক ও জ্ঞানগতভাবে দুর্বল হয়ে পিছিয়ে পড়ে। নানান রকম গুজবে তাদের কান ও মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এর ফলে গ্রামের জনগণ বিবিধ কুসংস্কার ও পিছনে পড়া জীবনাচরণের জঠাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে রাষ্ট্রের সবল নাগরিক হিসেবে পরিবারে ও রাষ্ট্রকে শক্তি যোগাতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। শিক্ষিত ও তথ্যসমৃদ্ধ সুস্থ-সবল নাগরিক রাষ্ট্রের শক্তি, তা গড়ে তোলার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রের উন্নয়নের সহায়ক হাতিয়ার হতে পারে। গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে গ্রামের জনসাধারণকে আমাদের সমাজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানান বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচয় ঘটিয়ে সংস্কৃতির জাগরণ ঘটানো যেতে পারে। কৃষি, মৎস্যপালন, পশুপালন, পানচাষ, লবণচাষ, সবজীচাষ,মসলা চাষ ঋতুভিত্তিক ফলচাষ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তথ্য প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রচারমূলক পুস্তিকা সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারে সরবরাহ করে জনগণকে সহজে সচেতন ও সমৃদ্ধ করা যায়। তাছাড়াও সমাজে ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নানান রকম উন্নয়ন বিরোধী প্রচার-প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে গণগ্রন্থাগারের বিকল্প নেই।   

গ্রামের বৃহত্তর কৃষক সমাজের বিনোদনের উপকরণ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। তারা সারাদিনের কাজ সেরে ইউনিয়ন সদরে এসে হাটে-বাজারে জমায়েত হয়। তাদেরকে ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারে মিলিত হবার সুযোগ দিয়ে, তারা সংবাদপত্র পড়ে, দেশের গুণী শিল্পী-সাহিত্যিকদের রচিত সাহিত্য পাঠ করে, নানান পেশার উপযোগী সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের নির্দেশিকা পাঠ করে, তারা সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পেতে পারে। এর ফলে তারা আত্মিক ও জ্ঞনগতভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করবে। গ্রামের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুযোগ গ্রহণের দিক থেকে শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরাও ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারের সহায়তায় যার যার উপযোগী সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থ ও দৈনিক পত্রিকা পাঠ করে উপকৃত হতে পারে। রাষ্ট্রের পরিচালনায় গণগ্রন্থাগারের সুযোগ গ্রহণের অধিকার দেশের শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সকল জনগণের অধিকার। প্রধান-প্রধান শহরে এ সুযোগ আরও বৃদ্ধি করে অর্থাৎ শহরে জনসংখ্যার অনুপাতে, শহরের নানান প্রান্তে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা বৃদ্ধি করা যেমন প্রয়োজন, একই সাথে দেশের সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রের গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার বৈষম্যনীতির অবসান আবশ্যক।

বর্তমানে দেশের জেলা শহরে, উপজেলা সদরে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনার সরকারি উদ্যোগ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছে এখনো তেমন গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের অর্ধশিক্ষিত, কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে, স্বল্পসাক্ষর ও অব্যাহত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত নাগরিকদের মধ্যে গণগ্রন্থাগারের ভূমিকার কথা বলে শেষ করা যাবে না। একটি বিভাগীয় বা জেলা শহরে শুধু একটি করে গণগ্রন্থাগার দিয়ে শহরের সকল মানুষের গ্রন্থপাঠের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তার জন্য শুধু শহরেই দশ-বিশ গুণ সরকারের উদ্যোগে গণগন্থাগার স্থাপন করা প্রয়োজন। শহরের বিভিন্ন ব্লকের মানুষের চাহিদা মোতাবেত শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য যতোগুলি স্বাস্থ্যকেন্দ্র দরকার এবং গ্রামের মানুষের জন্য যতোগুলি উপজেলা হাসপাতাল ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র দরকার, মনের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ততধিক শহর ও গ্রামে সরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপন প্রয়োজন। বর্তমানে উপজেলা সদরে একটি গণগ্রন্থাগার রয়েছে দেখা যায়। তা কোথাও সচল আর কোনো কোনো উপজেলায় স্থবির বা অচল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় সামান্য-কিছু বইপত্র নিয়ে কোনো কোনো গণগ্রন্থাগার চলে। যে উপজেলার নির্বাহী অফিসার গণগ্রন্থাগারের প্রতি আগ্রহী ও দরদী, তিনি দয়া করে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলে লাইব্রেরিটি কোনো রকম চলে, অন্যথায় সারা বছর বন্ধ থাকে। কারণ সরকারিভাবে উক্ত লাইব্রেরি খোলা-বন্ধ করা এবং পাঠকের জন্য মানসম্মত পাঠ-উপযোগী করে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদনের জন্য সরকারীভাবে বেতনভোগী কোনো কর্মচারী বা লাইব্রেরিয়ান উপজেলা গণগ্রন্থাগারগুলোতে নেই। জানা যায়, বর্তমানে ভলান্টিয়ার কর্মী দিয়ে উপজেলা গণগ্রন্থাগার পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। নানা জনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে লাইব্রেরিয়ানকে নামে মাত্র ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাও নিয়মিত হয় না। এতে বোঝা যায়, উপজেলা সদরে অবস্থিত সরকা কর্মকর্তার ঐচ্ছিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত একটি গণগ্রন্থাগারের করুন অবস্থা। অনেক উপজেলায় গণগ্রন্থাগারটি সেভাবেও চলে না। ইউনিয়ন পর্যায়ে যেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের বসবাস তাতে কোনো গণগ্রন্থাগারের ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারী গণগ্রন্থাগার প্রবর্তনের কোনো নীতিমালা গ্রহণের উদ্যোগ রাষ্ট্রের আছে কিনা আমাদের জানা নেই।

এখানে প্রস্তাব করা হচ্ছে, উপজেলা গণগ্রন্থাগার ও ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগার কিভাবে প্রবর্তন করা যেতে পারে। দেশের নানান পর্যায়ে রাষ্ট্রের মাধ্যমে যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসানের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অতীতে রাষ্ট্রের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণগ্রন্থাগার স্থাপন ও পরিচালনায় যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সারাদেশে সকল নাগরিকের গ্রন্থপাঠের ও তথ্য-জানার অধিকার বাস্তবায়নের নিমিত্তে উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার জন্য বাজেট প্রণয়ন আবশ্যক। আরো প্রয়োজন হবে, উপজেলা ও ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারের জন্য গণগ্রন্থাগার অধিতপ্তরের উদ্যোগে একটি নীতিমালা প্রণয়ন। এখানে উপজেলা সদরে ও ইউনিয়নভিত্তিক গণগ্রন্থাগার স্থাপনের একটি কাঠামোর রূপরেখার পরিকল্পনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

উপজেলা গণগ্রন্থাগার প্রবর্তন

বর্তমানে প্রায় উপজেলায় সুপ্রতিষ্ঠিত উপজেলা কমপ্লেক্স বিল্ডিং নির্মিত হয়েছে। সেখান থেকে একটি কক্ষ গণগ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। তাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন লাইব্রেরিয়ানকে সরকারীভাবে উপজেলা লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত করা যেতে পারে। তিনি উপজেলার কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। উপজেলা লাইব্রেরিয়ান তার প্রতিদিনের উপস্থিতি ও কাজের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের নিকট রিপোর্টেবল হবেন এবং টেকনিক্যাল কাজের জন্য তিনি জেলা লাইব্রেরিয়ানের নিকট রিপোর্টেবল থাকবেন। উপজেলা গণগ্রন্থাগারের সার্বিক ভালো-মন্দ উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার তদারকী করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন। জেলা লাইব্রেরিয়ান জেলার সকল উপজেলা লাইব্রেরিয়ানের উপস্থিতিতে জেলা লাইব্রেরিতে প্রতি তিনমাসে একটি রিফ্রেশারর্স সভা করবেন। সভায় স্ব স্ব উপজেলা লইব্রেরির কাজের নানান বিষয় আলোচনা করা হবে এবং গ্রন্থাগারের জন্য লিখিতভাবে গ্রন্থের চাহিদা গ্রহণ করা হবে। সকল উপজেলা লাইব্রেরিয়ান জেলা লাইব্রেরিয়ান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি ফরমেটে উক্ত সভায় প্রতিবেদন জমা দেবেন। উক্ত প্রতিবেদন সকলের উপস্থিতিতে জেলা লাইব্রেরিয়ান আলোচনা করবেন। সকল উপজেলা গণগ্রন্থাগারের চাহিদা পূরণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জেলা লাইব্রেরিয়ান সুপারিশ প্রেরণ করবেন। উপজেলা গণগ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দকৃত গ্রন্থ-বিতরণ পদ্ধতি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর নির্ধারণ করবেন। জেলা লাইব্রেরিয়ান প্রতি তিনমাসের মধ্যে অন্তত একবার জেলায় অবস্থিত উপজেলা গণগ্রন্থাগারসমহূ পরিদর্শন করবেন।

ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগার প্রবর্তন

রাষ্ট্রের অধিকাংশ লোক বাস করে ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং তারা অনেক কিছুর বৈষম্যের শিকার এবং তারা দৈনন্দিন জীবনের উন্নত ও আধুনিক জীবনযাত্রার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত। তেমনি ইউনিয়ন পর্যায়ের বিপুল লক্ষ-সহস্র মানুষ গণগ্রন্থাগারের নাম-গন্ধ-স্পর্শের বাইরে, তারা গণগ্রন্থাগারের সম্পূর্ণ সুবিধা-বঞ্চিত। এ ধরনের চরম বৈষম্যের অবসান এখনই হওয়া উচিত। দেশের সকল ইউনিয়নে এখন প্রায় আধুনিক ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মিত হয়েছে। দু-একটি ব্যতিক্রম থাকতে পারে। নতুন ধরনের এই দ্বিতল ভবনে অনেকগুলো কামরা রয়েছে। গ্রামের মানুষের সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেই উক্ত ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের কক্ষগুলো রাষ্ট্রের সেবামূলক উপজেলা দপ্তরসমূহের সম্প্রসারিত শাখা হিসেবে ব্যবহার করার নিমিত্তে নির্মিত। এই কক্ষগুলো থেকে একটি কক্ষ ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারের জন্য বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। এলাকার (ইউনিয়নের) একজন উচ্চমাধ্যমিক পাস নারীকর্মীকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত করা যেতে পারে। উপজেলার সকল ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ানকে একসাথে জেলা লাইব্রেরিয়ন এক সপ্তাহের গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেবেন। তাতে উপজেলা লাইব্রেরিয়ানও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন। ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ানগণের প্রাত্যহিক কাজের সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করবেন ইউনিয়ন পরিষদ সচিব। টেকনিক্যাল বিষয়ের সুপাভাইজার হবেন উপজেলা লাইব্রেরিয়ান। প্রতি দুইমাসে ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ানগণ উপজেলা লাইব্রেরিয়ানের অফিসে এসে একটি রিফ্রেসারর্স সভা করবেন এবং তাতে জেলা লাইব্রেরিয়ান কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি ফরমেটে উপজেলা লাইব্রেরিয়ানের নিকট ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ানগণ প্রতিবেদন জমা দেবেন। উপজেলা লাইব্রেরিয়ান সকল ইউনিয়ন লাইব্রেরিয়ানের রিপোর্ট সমন্বিত করে জেলা লাইব্রেরিয়ানের নিকট নির্ধারিত ফরমেটে ই-মেইলে সমন্বিত প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। উপজেলা লাইব্রেরিয়ান প্রতি তিন মাসে উপজেলার সকল ইউনিয়ন লাইব্রেরি অন্তত একবার পরিদর্শন করবেন।

গণগ্রন্থাগারকে ঘিরে সাংকৃতিক কর্মকান্ড প্রবর্তন

জেলা ও উপজেলা গণগ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে আরও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করা যেতে পারে। জেলা ও উপজেলা লাইব্রেরিয়ানগণ গ্রন্থাগার পরিচালনার পাশাপাশি সারা বছরব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পাঠচক্র পরিচালনা করতে পারেন। দেশের বরেণ্য শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিকদের জন্মদিনে স্থানীয় স্কুল-কলেজ ও সমাজের বিজ্ঞ ও গুণী ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাদের জীবন ও কর্মের আলোকপাত করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে। বিশেষ-বিশেষ জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা, জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন গ্রন্থালোচনার উদ্যোগ গণগ্রন্থাগার গ্রহণ করতে পারে। দিবস ও আলোচ্য গ্রন্থগুলো গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর পূবেই নির্ধারণ করে তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করবেন। সেই কাজগুলো পরিচালনার জন্য, অভ্যাগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য, প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ থাকা বাঞ্চনীয়। সকল উপজেলা ও ইউনিয়ন গণগ্রন্থাগারে একটি করে কম্পিউটার রাখা প্রয়োজন, তাতে ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে, যাতে শিক্ষার্থীরা ও সমাজের নানান ব্যক্তি ইন্টারনেটের মারফৎ আরও অধিকতর সংবাদপত্র ও প্রয়োজনীয় পিডিএফ গ্রন্থাদি পাঠ করতে পারেন।

সম্প্রতি ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের মধ্যে যে নবজাগণের আকাক্সক্ষার উদয় ঘটেছে, তার স্ফূরণ, সংহত ও বিকাশের লক্ষ্যে, সর্বোপরি দেশে সাংস্কৃতিক জাগরণ সৃষ্টির নিমিত্তে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জেলার গণগ্রন্থগারের সম্প্রসারণ এবং উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক আধুনিক গণগ্রন্থাগার প্রবর্তনের মাধ্যমে দেশে নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

রোগীর ‘গলা কেটে’ ডাক্তারের উপহার
পরিচয় লুকিয়ে আন্দোলন উসকাচ্ছে পতিত শক্তি
আজ থেকে শুরু বিএনপির দেশব্যাপী সমাবেশ
বাজছে নির্বাচনি দামামা
শেখ হেলালের ব্যক্তিগত সহকারী মুরাদ বিমানবন্দরে গ্রেফতার

সর্বাধিক পঠিত

বাহুবলে ডেভিল হান্ট অভিযানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
বহিষ্কার হলেন অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আবিদ হাসান জজ মিয়া
ডেভিল হান্ট অভিযানে সিরাজগঞ্জে গ্রেফতার ১০
ছুটি কাটিয়ে আর কর্মস্থলে ফিরেনি এডিসি আখতার
সুন্দরগঞ্জ হাসপাতালে দীর্ঘদিন পর চালু হলো আল্ট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রে সেবা

মুক্তমত- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2024 Kholakagoj
🔝