দেশের ব্যাংক খাতে মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল লেনদেন ও অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রসারে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। গ্রাহক এখন ঘরে বসেই টাকা স্থানান্তর, বিল পরিশোধ বা বিনিয়োগের কাজ করছেন। কিন্তু এই প্রযুক্তিনির্ভর উন্নতির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক রূঢ় বাস্তবতা। সারা দুনিয়াজুড়ে সাইবার হামলা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিতে দেশ যতটা দ্রুতগতিতে এগিয়েছে, প্রযুক্তির নিরাপত্তাব্যবস্থার ততটা অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি ব্যাংক সাইবার হামলা প্রতিরোধে অক্ষম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক খাতে অন্তত ১৩ ধরনের সংগঠিত সাইবার হামলার ঘটনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ‘অ্যাডভান্সড পারসিসট্যান্ট থ্রেট’ (এপিটি) বা গুপ্ত হামলাই ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ম্যালওয়্যার, ব্যাকডোর ইনস্টলেশন, স্পিয়ার ফিশিং, র্যানসমওয়্যার, ক্লিকজ্যাকিং বা এসকিউএল ইনজেকশন হামলাও ঘটেছে নিয়মিত।
এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নয়; এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা-ঝুঁকিও বটে। ক্যাসপারস্কি ল্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সাইবার হামলার হুমকি শনাক্তের সংখ্যা ছিল সাত লাখের বেশি- যা আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা যত এগোচ্ছি, হ্যাকারদের নিশানায় পড়ার হারও তত বাড়ছে।
জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে (ইজিডিআই) বাংলাদেশের অবস্থান এখনো ১০০তম, আর ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্সে ৪৮তম। এতে বোঝা যায়, আমরা কাঠামোগতভাবে কিছুটা এগোলেও বাস্তব সুরক্ষা ও কার্যকারিতায় এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। একদিকে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে, অন্যদিকে সাইবার সুরক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়নি।
‘প্রযুক্তি যত বাড়ে, ঝুঁকিও তত বাড়ে।’ আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও তা পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট লোকবল নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে এই ঘাটতি আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে। সাইবার হুমকি মোকাবিলায় যে দুটি বিষয় সবার আগে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেটি হলো সচেতনতা ও সক্ষমতা। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন থাকা দরকার, লেনদেন করার সময় ভালোভাবে ভেরিফাই করে নিতে হবে। এবং একই সঙ্গে বাড়াতে হবে প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকেও যাতে সুদক্ষ হ্যাকারও প্রতারণা না করতে পারে। সিকিউরিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।
তাই এখন সবচেয়ে জরুরি হলো, সাইবার সুরক্ষাকে ‘প্রযুক্তিগত খরচ’ নয়, ‘জাতীয় বিনিয়োগ’ হিসেবে দেখা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি সংস্থাগুলোকেও সাইবার ঝুঁঁকিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে আনতে হবে। দরকার একটি সমন্বিত জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কৌশল, যেখানে থাকবে দক্ষ জনবল তৈরি, অবকাঠামো উন্নয়ন, জরুরি প্রতিক্রিয়া ইউনিট এবং সাইবার শিক্ষার প্রসার। ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ- যে নামেই বলা হোক না কেন, তার মূল ভিত্তি হবে নিরাপদ ডিজিটাল অবকাঠামো। সাইবার নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত করা না যায়, তবে ডিজিটাল অগ্রগতি একসময় নিজেই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় ঝুঁঁকি।
কেকে/ আরআই