অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া জুলাই সনদ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার নিরসন চায় জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। এর সমাধান সরকারকেই করতে হবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সার্বিকভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের কাছে জমা দেওয়া জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির মধ্যে চাপা ‘ক্ষোভ’ বিরাজ করেছে।
দলটির নেতারা মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে। ফলে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে সরকারকে আর ছাড় দিতে চাইছে না বিএনপি। যদিও এ নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ না জড়ালেও জনগণের মনোভাব বুঝে কঠোর অবস্থানে যাবে দলটির শীর্ষনেতারা। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের অবস্থানকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেছেন বিএনপি নেতারা। এদিকে জামায়াতের সঙ্গে বিরোধ এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। দুদলের নেতারা আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন।
সম্প্রতি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে অবিলম্বে সরকারি আদেশ জারি করে একটি গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করেছে। এরপর থেকে শুরু হয় নানা বিতর্ক। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট আগে হবে নাকি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হবে এ নিয়ে রাজনীতিতে বাড়ছে উত্তাপ। তবে এই নিয়ে এখনই কঠোর কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চায় না বিএনপি ও দলটির মিত্র দলগুলো।
জানা গেছে, জুলাই সনদ ইস্যুতে আর সময়ক্ষেপণ করতে চায় না বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের আলোচনায় উঠে এসেছে নোট অব ডিসেন্টসহ স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায় নেতারা। এর জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপি আর সরকারকে কোনো ‘অনুরোধ’ করবে না। এ ছাড়া সরকার প্রধানের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজনীয়তাও দেখছেন না দলটির নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট নিয়ে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এটা আমাদের দলীয় বক্তব্য।
এ ছাড়া বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে হবে। নির্বাচন যে হবে তা সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। রাজনৈতিকদলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি করে সবাইকে এখনই আস্তায় আনা দরকার। প্রশাসনের মধ্যে পেশাদারিত্ব আনা যায়নি। এখনই তা কাটিয়ে উঠা দরকার। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে এটা তিনি চার দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আশা দরকার। আগামী নির্বাচন কোনো করাণে প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে পরবর্তিতে সরকার চালানো কঠিন হয়ে পারবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ আমরা দেখে শুনে স্বাক্ষর করলাম, প্রধান উপদেষ্টাও একজন স্বাক্ষরকারী। এর দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বিশ্বাস ভঙ্গের কারণ হবে। এখানে কমিশনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে প্রতরণা। এনিসিপিরও অভিযোগ রয়েছে। সরকারকে অভিযুক্ত করছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ সুপারিশলা থেকে বের হয়ে সমাধান করা। এখানে সরকারের যদি অনাগ্রাহ থাকে তাহলে বুঝব নির্বাচন নিয়ে সরকার ভিন্ন কোনো এজেন্ডা আছে। সরকার যদি দল কিংবা জনগণের ওপর এ সংকট চাপিয়ে দেয় তখন তো এ সরকার নিয়ে এগোনো যাবে না।
জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, জমা দেওয়া জুলাই সনদ নিয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। স্বাক্ষর করার পর দেখেই তো সাইন করেছি। স্বক্ষর করার পর এখানো সংযোগন বিয়োজন করলে তো প্রতারণাই হবে। এটা বাজে কাজ হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাই। অধিকাংশ দলই নির্বাচনের কথা বলছে। সুতরাং সরকারকে একটা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকারের কাছে জমা দেওয়া জুলাই সনদের সুপারিশ নিয়ে বিএনপি এবং মিত্রদলগুলোর নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, জুলাই সনদ নিয়ে কমিশন প্রতারণা করেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যে জুলাই সনদ আমরা পাস করেছি, আমাদের মনে আছে, পার্লামেন্টের সামনে বৃষ্টি হচ্ছিল। ছাতা ধরে পাস করেছি, সই করেছি। ওইখানে আমরা যে বিষয়গুলো সই করেছি সেখানে বলা হয়েছিল- যেসব রাজনৈতিক দল যেগুলোতে একমত তা সব সই হয়ে গেল। এমনকি যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে না, তারা সেটাকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করবে। আর এখন তারা যেটা প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে, সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্টে’র কোনো কথাই নেই। তারপরও দেখেন, একটা দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা একটা প্রেস কনফারেন্স করে বলেছি। আমরা রাস্তায় যাইনি। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো প্রতিবাদ করিনি। আমরা প্রধান উপদেষ্টার বাড়ি ঘেরাও করিনি বা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করিনি। আমাদের কথা খুব পরিষ্কার। আমরা যেটা সই করেছি, আমরা অবশ্যই সেটার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করব। কিন্তু যেটা আমরা সই করিনি সেটার দায়দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করব না।
গত সপ্তাহে জুলাই সনদের সুপারিশনামা সরকারের কাছে জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়া জুলাই সনদ জমা দেওয়ার বিষয়টি সামনে এলে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। এরপর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম বৈঠক করে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারকে এ সংকট নিরসনে আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া জুলাই সনদ নিয়ে বিএনপির অবস্থান সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরা হয়। জনগণের মনোভাব বুঝে কঠোর অবস্থানে যাবে বিএনপি।
বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা খোলা কাগজকে বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে সরকার বিএনপিকে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টা করছে। এমনটা এখন দেশের সচেতন নাগরিকরা ফোন করে আমাদের বলছেন। ফলে দেশের মানুষের মনোভাব বুঝেই সরকারকে আর কোনো ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংকটের সমাধান করতে হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, আমাদের জুলাই সনদের প্রয়োজন নেই। একটি সংসদ প্রয়োজন, যারা গণতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করবে। তিনি বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ভুলিয়ে দিতে চায়। এ সরকার কোথাও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে না এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার চেষ্টা চলছে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ সংগ্রামের সঙ্গে অন্য কোনো আন্দোলনের তুলনা হয় না। এ দেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
জামায়াতে ইসলামীর দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, আজ ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন ঘিরে নানা ষড়যন্ত্র করছে। তিনি হুঁশিয়ারি দেন, যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হয়, তবে তাদের প্রতিহত করা হবে।
এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক নিষিদ্ধকরণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির পুনরুত্থান রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আলাল বলেন, বিএনপি এখন এমন অবস্থায়এসে দাঁড়িয়ে যাদের প্রয়োজন, তারা নিজেদের স্বার্থে এ দলকে ব্যবহার করে নিচ্ছে। বিএনপি আজ অর্জুন গাছের ছালের মতো যার দরকার পড়ে, কেটে নেয়।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী গতকাল শনিবার দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো এক জরুরি ভিডিও বার্তায় দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের এ কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে গিয়ে একটি অসম ও অবৈধ চুক্তি, একটি দলের চাপে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং সর্বশেষ একই উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মার্কা ব্যবহারের বিষয়ে আবার সেটা পুনর্বিবেচনার নামে একটি দলের প্রতি যে আনুগত্য প্রকাশ করেছে সরকার, নিঃসন্দেহে এতে এ সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা এ সিদ্ধান্ত মানি না এবং এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিন্দা জানাচ্ছি।’
মো. তাহের জোর দিয়ে বলেন, নির্বাচন কমিশন এবং উপদেষ্টা পরিষদে ‘প্রতিটি দলকে নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে’ বলে যে দুটি সিদ্ধান্ত হয়েছিল, জামায়াতে ইসলামী সে সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত এবং জাতিও একমত। প্রধান উপদেষ্টা তার নিজস্ব ‘সংস্কার-রিফর্ম’সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না। যদি প্রধান উপদেষ্টা সেই ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তবে জাতি মনে করবে তিনি জাতির সঙ্গে ‘খেলাফ’ করছেন। তিনি দৃঢ় ভূমিকা পালন করে সংস্কার বাস্তবায়নে যথার্থ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আহ্বান জানান।
তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ‘আমরা গত বৈঠকে গৃহীত সেই সিদ্ধান্তকে আবার পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্যথায় এর বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ হবে। সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি নতুন করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে এটি একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত।
তিনি মনে করেন, জনগণ ফেব্রুয়ারিতে যে একটি জাতীয় নির্বাচন চাইছে, নির্বাচনের ঠিক আগে হঠাৎ এ রকম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা-উত্তাপ তৈরি করা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকার সমালোচনা করে তাহের বলেন, ‘এরকম অশুভ চক্রের কাছে প্রধান উপদেষ্টা নতিস্বীকার করবেন, বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং ষড়যন্ত্রের কাছে নতিস্বীকার করে উনি সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাবেন, এটা আমরা আশা করি না।’
কেকে/এআর