ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৬ ভাদ্র ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পুলিশ কী পারবে মানুষের ক্ষোভ দূর করতে

খোলা কাগজ প্রতিবেদক
🕐 ৯:০৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ০৯, ২০২৪

পুলিশ কী পারবে মানুষের ক্ষোভ দূর করতে

অগ্নিদগ্ধ ভবনটিকে দেখা বোঝা মুশকিল এটি একটি থানা। আগুনে পুড়ে দেয়ালগুলো কালো হয়ে গেছে। ভেতরের কক্ষগুলোতে শুধুই ধ্বংসস্তূপ। থানার সামনে স্তূপ করে রাখা আছে পুলিশের কিছু পোশাক, কয়েক জোড়া বুট, কিছু বুলেট প্রুফ জ্যাকেট এবং আরো সরঞ্জাম। সব কিছুই অর্ধেকের মতো পোড়া, ব্যবহারের উপযুক্ত নয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকার মিরপুর মডেল থানায় গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়। এ থানার আটজন আনসার সদস্য ডিউটি করছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ কতটা পুঞ্জিভূত হয়েছিল, মিরপুর থানা যেন সেই সাক্ষ্য বহন করছে।

থানার সামনে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি দেখছিলেন অফিসগামী কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের এমন অবস্থা হইব, এইটা ভাবতেও পারি নাই।’ শুধু মিরপুর থানা নয়, বাংলাদেশের থানাগুলোতে কোন পুলিশ নেই গত সোমবার দুপুরের পর থেকে। একযোগে সব থানা ফেলে পুলিশ সদস্যদের পালিয়ে যাবার ঘটনা অতীতে বাংলাদেশে কখনো দেখা যায়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এ ধরণের ঘটনা বিরল বলে উল্লেখ করছেন বর্তমান ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, অনেক সময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এ ধরণের ঘটনা দেখা যায়। পুলিশের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন সেটি এক বড় প্রশ্ন। যখন মন চাইছে গুলি চালাইছে : ঢাকার ভাটারা থানায় গিয়ে দেখা গেল সেটির অবস্থাও মিরপুর থানার মতো। অগ্নিসংযোগের পর চারিদিকে এখন শুধু ধ্বংসস্তূপ। থানার ডিউটি করছেন কয়েকজন আনসার সদস্য। ভেতরে ঢুকতেই দেখা মিললো একদল ছাত্র-ছাত্রীর সাথে। তারা জানালেন, থানার বাইরে যেসব ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে সেগুলো পরিষ্কার করতে এসেছেন তারা। পুলিশ নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের সবাই ব্যাপক ক্ষোভ ঝাড়লেন। যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ রয়েছে সেটি কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে কীভাবে?

‘এটা কাটবে জনগণের সাথে সংহতিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে, নরম ব্যবহারের মাধ্যমে,’ বলছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুর রাজ্জাক। ‘পুলিশের সাথে কথা বলতে গেলে ভয় পাইতাম। পুলিশ খারাপ ব্যবহার করতো। তাছাড়া ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ বর্বর আক্রমণ করেছে। যখন মন চাইছে গুলি চালাইছে,’ বলছিলেন ঢাকার নিউ মডেল কলেজের ছাত্র শাহজালাল পাটোয়ারি। পুলিশের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ নিয়ে অবগত আছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ‘চরম অনাস্থা’ তৈরি হয়েছে ২০১২ সালে থেকে, যখন পুলিশ ব্যাপক শক্তি প্রয়োগ করা শুরু করে। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের কাজে যোগ দেবার জন্য বলা হয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব কাজে যোগ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যায়, তত দ্রুত পুলিশের ওপর আস্থা ফিরে আসবে।

তিনি স্বীকার করেন, পুলিশের আচরণগত সমস্যার কারণেও মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এসব কিছুর বহিঃপ্রকাশ একসাথে হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি পুলিশের জন্য বেশ জটিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।বিভিন্ন থানা থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুট হয়েছে। অনেক পুলিশের পোশাক নেই। এবং বহু থানায় বসার মতো কোন পরিস্থিতি নেই।

গতকাল ঢাকার কয়েকটি থানায় গিয়ে দেখা গেল, ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছেন সিটি কর্পোরেশনের কিছু কর্মী। ঢাকার পল্লবী থানার সামনে গিয়ে দেখা গেল, স্থানীয় একদল মানুষ গেটের সামনে জড়ো হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাজ্জাদ হোসেন।

তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে পারছেন না। সেজন্য স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। ‘এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ তো লাগবে। ওনারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন,’ বলছিলেন সাজ্জাদ হোসেন।

পুলিশের উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে : পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে গিয়ে বিভিন্ন থানায় ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছেন। সেখানে কথা হচ্ছিল সাব-ইন্সপেক্টর আব্দুল লতিফের সাথে। তিনি বলেন, মিরপুর অঞ্চলে যতগুলো থানা আছে সবগুলোতে গিয়ে তারা ক্ষতি নিরূপণ করছেন। তিনি জানান, বিভিন্ন থানায় পুলিশের যানবাহন কিছু অবশিষ্ট নেই। সব জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূলে থাক না কেন, পুলিশ সদস্যদের মাঠে যেতেই হবে। অন্তত তাদের শুরু করতে হবে। সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা বলছিলেন, ‘পুলিশের উপস্থিতি দৃশ্যমান করতে হবে। তারা বিভিন্ন স্থাপনায় গিয়ে সেগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতে পারে। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে পুলিশের ওপর আস্থা রাখবে সাধারণ মানুষ।’

পুলিশ নিয়ে সার্বিকভাবে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ আছে সেগুলো নিরসনের জন্য পুলিশের সংস্কার করা জরুরী। এই সংস্কার খুব দ্রুততার সাথে করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন নুরুল হুদা। তিনি মনে করেন, পুলিশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় আছে। কারণ বহু বছর ধরে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

এদিকে, পুলিশ কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুলিশের মধ্যে একটি বড় ধরণের পরিবর্তন বেশ অবশ্যম্ভাবী। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সবগুলো থানার ওসি এবং প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপারদের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

বিক্ষোভের সময় যেসব জায়গায় পুলিশ বেশি শক্তি প্রয়োগ করেছে সেখানে পরিবর্তন আসবে সবার আগে। এছাড়া বাকিসব পরিবর্তন ধাপে ধাপে করা হবে বলে যে কর্মকর্তা জানান।

তিনি মনে করেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং অতীতে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত তাদের শাস্তি না দিলে পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফেরানো কঠিন হবে। কিন্ত এসব কাজ একযোগে করা সম্ভব নয় বলে সে কর্মকর্তা উল্লেখ করেন।

 

 
Electronic Paper