ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কষ্ট বাড়ে আগস্টে

সুব্রত চৌধুরী
🕐 ১:১৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২১

কষ্ট বাড়ে আগস্টে

সামার ভ্যাকেশনে দেশে আসার পর থেকেই পাপাইর চোখে পড়েছে ব্যাপারটা, দাদুর মধ্যে কেমন যেন এক ধরনের অস্থিরতা। বারান্দায় ইতস্তত পায়চারি করেন, আর দেওয়ালে ঝোলানো বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলেন।

ব্যস্ততার কারণে দাদুকে এই ব্যাপারে তার জিজ্ঞেস করাই হয়নি। গত ক’দিন বাড়িতে লোকজনের যা আনাগোনা। আজ একটু ফাঁকা হতেই দাদুকে সে জিজ্ঞেস করে, তোমার কী শরীর খারাপ করেছে?
-না, না...।
-তাহলে এভাবে পায়চারি করছ কেন? আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছ!
-আমার না কিছুই ভালো লাগছে না।
-কেন?
ইশারায় দাদু দেওয়ালে ঝোলানো বঙ্গবন্ধুর ছবিটাকে দেখায়।
পাপাই ছবিটার দিকে তাকায়, সিঁড়ির ওপর পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর লাশের ছবি।
পাপাইর আর বুঝতে বাকি থাকে না কেন দাদুর মন খারাপ, সে দাদুকে ধরে আরাম কেদারায় বসিয়ে দেয়। দাদু আরাম কেদারায় বসে বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে পচাওরের মধ্য আগস্টের জাবর কাটতে থাকে।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট, অনিমেষ বাবু প্রতিদিনকার মতো ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। রাস্তায় নামতেই তার খটকা লাগে, ভোরের পথচারীদের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা ভাব, ফিসফিসানি। হঠাৎ সাঁই সাঁই করে জলপাই রংয়ের জিপ, ট্রাক ছুটে যাওয়াÑ কেমন একটা গুমোট ভাব চারদিকে। অনিমেষ বাবু সাতপাঁচ না ভেবেই বাসায় ফিরে এসেছিলেন, রেডিওর নব ঘোরাতেই সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
যে লোকটা ‘আমার দেশের মানুষ’ বলে বলে মুখে ফেনা তুলতেন, যাদের সুন্দর আগামীর জন্য সারা জীবন কষ্ট করেছেন, সংগ্রাম করেছেন সেই নিজের দেশের মানুষের হাতেই তিনি মারা পড়লেন। শোকে, দুঃখে তার দু’চোখ জুড়ে তখন শ্রাবণধারা ঝরেছিল।
-জানিস পাপাই, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। ওইদিনই আমি ধনুভাঙা পণ করেছিলাম যতদিন পর্যন্ত এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে না ততদিন পর্যন্ত আমি জুতো পরব না।
-সত্যিই তাই!
-হ্যাঁ।
-তুমি নিশ্চিত ছিলে এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবেই।
-কেন হবে না। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম। যদিও বিচারের পথ এত মসৃণ ছিল না। পদে পদে অনেক বাধা, দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে আটকে রাখতে পারেনি।
: কেন দাদু?
-কীভাবে পারবে বল, সারা দেশের মানুষের প্রাণের আকুতি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, সবাই এই বিচারের অপেক্ষায় ছিল। যেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় ঘোষিত হয় সেদিনের অবস্থা যদি তুই দেখতি।
-প্লিজ, বলো না দাদু।
-বলছি, শোন। সেদিন সকাল থেকেই সারা দেশের মানুষ খরগোশের মতো কান খাড়া করে রেখেছিল বিচারের রায় শোনার জন্য। প্রায় সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। বিচারক রায় ঘোষণার পর দেশের মানুষের বুকের ওপর বছরের পর বছর চেপে থাকা জগদ্দল পাথরটা সরে গিয়েছিল। সারা দেশের মানুষের মনে তখন খুশির জোয়ার, সবার সে কী বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস! ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগানে সারা দেশ থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।
-তুমি কী করেছিলে দাদু?
-আমিও সেই উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিলাম।
-যেমন?
-আমার শরীরের সব শক্তি দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সবার সঙ্গে শ্লোগান ধরেছিলাম, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। আমার দু’চোখ বেয়ে তখন গড়িয়ে পড়েছিল আনন্দাশ্রু।
-তাই!
-হ্যাঁ। আমার শরীরে তখন একাত্তরের তেজ। বলতে বলতে খুশিতে দাদুর চোখ মুখ যুদ্ধজয়ীর মতো চিকচিক করে উঠল।
-আর তোমার জুতো পরার ব্যাপারটা?
-শহীদ মিনার থেকে বাসায় ফেরার পথে জুতো কিনে এনেছিলাম, ওইদিনই আমি অনেক বছর পর আবার জুতো পরি।
-কেমন লেগেছিল তখন তোমার?
-তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না দাদু। আমি এখন মরেও শান্তি পাব।
-কেন?
-জাতির জনক হত্যার বিচার দেখে যেতে পারলাম, হত্যাকারীদের ফাঁসি কার্যকর হতে দেখলাম। এই জীবনে আর কী পাওয়ার আছে বল?
-ঠিক বলেছ।
দাদু আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে জনকের ছবিতে হাত বুলোতে বুলোতে বিড়বিড় করতে থাকেনÑ সিঁড়ির ’পরে লুটোয় ধুলোয় বাংলাদেশের সুখ’।

অলংকরণ : আফিয়া আলম রাকা
তৃতীয় শ্রেণি, জেলা সদর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper