বঙ্গবন্ধুর কাছে চিঠি
শাহেদ জাফর হোসেন
🕐 ১২:২৮ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২১
অনেকদিন ধরেই সাজ্জাদ ভাবছিল বাবাকে তার ইচ্ছার কথাটি বলবে। কিন্তু বলা হয়নি। বাবা একমাস দু’মাস পরপর বাড়িতে আসেন। এসে ব্যস্ত হয়ে যান বিভিন্ন কাজে। ঢাকায় যারা চাকরি করে তারা বুঝি এমনই হয়, ঠিক বাবার মতো!
তবুও সাজ্জাদ ভাবল আজ রাতে ভাত খেতে বসে বাবাকে কথাটি বলবে। বলবেই বলবে। যা হয় হবে! রাতে ঘরের বারান্দায় কুপির আলোতে একসঙ্গে সবাই খেতে বসে। বাবার হয়তো কাজ ছিল তাই তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে উঠে যাচ্ছিলেন।
সাজ্জাদ তখন বাবাকে বলল- বাবা, আমাকে তুমি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবে?
ছেলের কথা শুনে বাবা না হেসে পারল না। কী যে বলে ছেলে! বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে দেখা করবে কেন, এতটুকু একটা ছেলের সঙ্গে। আর তিনি তো দেশের রাষ্ট্রপতি। তার কত কাজ। কাজ রেখে বাবা হয়ে নিজেই তার ছেলেকে সময় দিতে পারেন না আর দেশের প্রেসিডেন্ট সময় দেবে এই ছেলেকে!
বাবা সাজ্জাদকে বললেন, আমি এবার ঢাকায় যাই। গিয়ে অফিসের স্যারদের কারও কাছ থেকে জেনে নিই কীভাবে দেখা করতে হবে বঙ্গবন্ধুর সাথে। তিনি তো ব্যস্ত মানুষ, আর আমিও জানি না কীভাবে দেখা করতে হবে তার সাথে।
এ কথা বলে বাবা উঠে চলে গেলেন।
তারপর মাসখানেক চলে গেল এভাবেই। এর ভিতর বাড়িতে চিঠি আসে বাবার কয়েকবার।
মা যখন চিঠি পড়েন তখন সাজ্জাদ কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। চিঠিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা বাবা যদি কিছু জানায়, এই আশায়।
এর মাসখানেক পর বাবা বাড়িতে আসেন একদিন। সাজ্জাদ যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। বাবা বলেন, অনেক তো চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার সাথে দেখা করার কোনো রাস্তা খুঁজে পেলাম না।
সাজ্জাদ মন খারাপ করে না। অন্য একটা বুদ্ধি বের করে। একদিন টিফিনের সময় স্কুলে বসে বসে বঙ্গবন্ধুর কাছে একটা চিঠি লেখে-
প্রিয় বঙ্গবন্ধু,
আমার সালাম নেবেন। আমি সাজ্জাদ, আমার বয়স আট বছর। আমি ক্লাস থ্রিতে ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামের স্কুলে পড়ি। আপনি আমাদের জাতির পিতা। আপনাকে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছা খুব। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
চিঠিটি লিখে পোস্ট অফিসের বাক্সে ছুটির সময় ফেলে দিয়ে আসে সে। দিন যায়, সপ্তাহ যায়। মাস দুয়েক পর একদিন স্কুলের হেডস্যার তার রুমে ডেকে পাঠান সাজ্জাদকে। সাজ্জাদ খুব ভয় পেয়ে যায় হেডস্যারের জরুরি তলব পেয়ে। ভয় ভয় মন নিয়ে হেডস্যারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। কে যে তার নামে নালিশ করেছে বুঝতে পারে না। কারও সঙ্গে তো সে দুষ্টুমি করেনি আজ!
হেডস্যার গলার স্বর উঁচু করে বললেন, চিঠি দিয়েছিলি কাকে?
সাজ্জাদ খুব ভয় পেয়ে বলল- স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে।
হেডস্যার বললেন, না রে বোকা ভুল হবে কেন! তোর চিঠির উত্তর দিয়েছে দেখ কে? স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। দেখ পড়ে দেখ চিঠিখানা।
সাজ্জাদ খুশি ধরে রাখতে পারে না। হেড স্যারের হাত থেকে ছোঁ মেরে চিঠিখানা নিয়ে দৌড়ে সে চলে গেল ্সকুলের মাঠের পাশে বটগাছটার নিচে। কাঁপাকাঁপা হাতে চিঠি খুলে সে পড়ে দেখল বঙ্গবন্ধু তাকে বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আগামী ১৭ আগস্ট, রোববার ১৯৭৫; বঙ্গবন্ধু তাকে বাবা-মাসহ বাড়িতে ডেকেছেন। চিঠি পড়ে বুকটা গর্বে ভরে যায় সাজ্জাদের।
এতটা আনন্দ আগে হয়নি কখনো। চিঠি নিয়ে সাজ্জাদ চলে আসে বাড়িতে। বাড়ির উঠানে মা বসেছিলেন। সাজ্জাদকে দৌড়ে বাড়ি ফিরতে দেখে মা বললেন, কি রে এমন করে দৌড়ে এলি যে?
সাজ্জাদ বললÑ মা, জানো আমি কার চিঠি পেয়েছি?
-কার?
-বঙ্গবন্ধুর। সাজ্জাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
-বঙ্গবন্ধু আমার চিঠির উত্তর দিয়েছে। আমাদের সবার সাথে দেখা করবেন তিনি। আমরা ঢাকা যাব মা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। আমি চিঠি লিখেছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে। তিনি চিঠি পড়ে তার উত্তর পাঠিয়েছেন।
মা খুশি হন। ছেলেকে বুকে টেনে নেন। এ খবর কানে কানে পৌঁছে যায় গ্রামের সবার কাছে। চেয়ারম্যান সাহেব আসেন, মেম্বার সাহেব আসেন ছোট্ট সাজ্জাদকে দেখতে। সবাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার এমন ভালোবাসায় মুগ্ধ হন।
সাজ্জাদের অপেক্ষা আর ফুরায় না, ১৭ আগস্ট কবে আসবে এ চিন্তায় তার ঘুম আসে না। সাজ্জাদ প্রতিদিন রেডিওতে সকাল বেলার খবর শোনে। তারিখ জানার জন্য। শহর থেকে বাবাও বাড়িতে ফেরেন। সময় পেরিয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল বেলা খবর শুনতে বসে সাজ্জাদ। রেডিওতে খবরের শুরুতেই তারিখ বলে আজ ১৫ আগস্ট, শুক্রবার। তারপর...
তারপর রেডিওতে যা বলে খবর পাঠক, সে কথা সাজ্জাদ আর বিশ্বাস করতে চায় না। জোরে চিৎকার করে ওঠে সে। তার চিৎকারে বাবা বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন সাজ্জাদের কাছে।
বাবা বলেন, কী হয়েছে?
সাজ্জাদ চোখ মুছতে মুছতে বলে, বঙ্গবন্ধু আর নেই বাবা! তাকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকেই হত্যা করেছে শয়তানরা। কেউ আর বেঁচে নেই।
বাবা মাটিতে বসে পড়েন।
সাজ্জাদ আর কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। বঙ্গবন্ধুকে যদি দেখা যায় ওই আকাশের কোণে। বাংলার ওই আকাশটা বঙ্গবন্ধুই যে এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক দিয়ে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228