ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

খেসারত

হাফিজ উদ্দীন আহমদ
🕐 ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১

খেসারত

বড় ভাই সেভেনে, ছোট ভাই থ্রিতে। বাবাই পড়ান। যে বেতন পান তাতে সংসার চালিয়ে বাচ্চাদের জন্য আলাদা গৃহশিক্ষক রাখা সম্ভব হয় না। সাধারণের ধারণা ডাক্তার মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কিন্তু আসলে তা নয়। তরুণ সাধারণ ডাক্তারদের তেমন কোনো প্র্যাকটিস হয় না বললেই চলে উপরন্তু ডাক্তার হওয়ার সুবাদে মাসজুড়ে চিকিৎসার নাম করে গ্রামের আত্মীয়, তস্য আত্মীয় বাড়িতে এসে ওঠে। বাজার-হাট, ছোটদের স্কুলের খরচ দেওয়ার পর হাতে আর কিছু থাকে না। মাঝে মাঝে আত্মসম্মান খুইয়ে বন্ধুদের কাছে ধার চাইতে হয়। তবে এ মফস্বল শহরে সৎ বলে তার একটা সুনাম আছে। ঘুষ, ল্যাব পরীক্ষার কমিশন এসবের ধারে কাছেও তিনি নেই। রোগীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। সারাদিন প্রায় হাসপাতালে কাটিয়ে দেন। সেখান থেকে ফিরে যখন পড়াতে বসেন তখন সন্ধ্যা রাত হলেও ছেলেরা স্কুলের পর বিকালে খেলার মাঠে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত থাকে। বই খুলে বসলেই ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু করে। আর ওদের বাবা তখন গণিত নিয়ে ওদের অঙ্ক করাতে বসেন। সোজা সোজা অঙ্কগুলোও তাই ওরা ভুল করে। বাবা মেজাজ হারান।

স্কুলের সমাপনী পরীক্ষায় যে তিনটা বিষয়ে তিনি লেটার পেয়েছিলেন তা হলো ইংরেজি, আরবি আর অঙ্ক- যে তিনি অঙ্কে এত ভালো ছিলেন তার ছেলে অঙ্ক পারে না, এটা তার সহ্য হয় না। তারপর সারাদিন অফিস করে মেজাজ এমনিতেই তিরিক্ষি থাকে। ঠাস করে একটা চড় মারেন বড় ছেলের গালে। সে নীরবে অশ্রু ফেলে। কারণ জোরে কাঁদলে আরেকটা চড় খেতে হবে। দাঁত কিড়মিড় করে তিনি বলেন- একটা কিছু তো করে খেতে হবে। তোরা যখন লেখাপড়া করিস না, কালকে তোদের রিকশা কিনে দেব। দু’ভাই চালাবি।

রাতে ভাত খাওয়ার পর বড় ভাই সাকিব মন খারাপ করে শুতে গেল কিন্তু ছোট ভাই রাকিবের চোখে ঘুম নেই। এর আগে বহুদিন বাবার কাছে তিন চাকার সাইকেল কিনে দিতে বায়না ধরেছে। তবে টাকার অভাবে বাবা কখনো তার শখ পূরণ করতে পারেনি। কিন্তু সে বাবাই আজ স্বেচ্ছায় ছোট সাইকেল নয় তারচেয়ে অনেক বড় ট্রাইসাইকেল কিনে দিতে চাচ্ছে। রিকশা তো ট্রাইসাইকেলই। একটু চোখ লাগতেই স্বপ্ন দেখে- কী সুন্দর শহরময় সে রিকশা চালাচ্ছে। কত নতুন নতুন জায়গা দেখছে। ফুরফুরে বাতাসে তার চুল উড়ছে। পতপত করে নাচছে শার্টের কলার। রাতে দুই ভাই এক বিছানায় শোয়। বাবা-মা অন্য ঘরে থাকেন। সাকিব ভোস ভোস করে নাক ডাকাচ্ছে। কিন্তু রাকিব আধো ঘুম জাগরণে রাত কাটাল। কখন ভোর হবে? কালকেই সে পাবে ঝকঝকে নতুন রিকশা। কী মজা! তারপর ভনভন করে চালাবে সে।

সকালে উঠে রোজকার মতো নামাজের পর একটু হেঁটে এসে সেভ আর নাস্তা সেরে বাবা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে গেলেন। ইচ্ছা থাকলেও রাকিব তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার মওকা পেল না। একটু পর ওরা স্কুলে যাবে। নাস্তা খাওয়ার কিছু পর গোসল সেরে বইপত্র গুছিয়ে ভাত খেল। মা তার জামা কাপড় ঠিকমতো পরিয়ে থুতনি ধরে চুল আঁচড়ে দিতে লাগলেন। এই ফাঁকে রাকিব মন খারাপ করে জানতে চায়-

আব্বু তো বলেছিল সকাল হলেই রিকশা কিনে দেবে। কিন্তু না দিয়ে অফিসে চলে গেল কেন? কখন রিকশা কিনে দেবে মা?
মা থুতনি ছেড়ে আঁচল মুখে চেপে হাসি সামলান। বললেন- তোর বাবা এলে তাকেই জিজ্ঞাসা করবি। ঠিক আছে?
সন্ধ্যায় বাবা অফিস ফিরে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই রকিব দৌড়ে গেল। ওকে দৌড়ে আসতে দেখে বাবা খুশি হলেন। তারপরই তার প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হলেন- মিথ্যা কথা বলার জন্য তুমি না ভাইয়ার কান মলে দিয়েছিলে? তুমি না বলেছ মিথ্যা কথা বললে গুনাহ হয়?
: হ্যাঁ, হয়।
: তবে তুমি কেন মিথ্যা কথা বললে?
: আমি? কবে মিথ্যা বললাম?
: কেন? তুমি না বলেছিলে আজকে রিকশা কিনে দেবে। রিকশা কোথায়?
ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন বাবা এতক্ষণে। ছেলেদেরকে সবসময় মিথ্যা বলতে বারণ করেন। প্রয়োজনে শাস্তি দেন। সেই তিনিই আজ ছোট ছেলের কাছে মিথ্যুক প্রমাণিত। কী জবাব দেবেন বা কী করবেন ভেবে পেলেন না। তবে নিজ সন্তানের কাছে মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হতে চান না। পারতপক্ষে তিনিও তো কখনো মিথ্যা বলেন না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। রাতেই তিনি ওয়ার্ড বয় ছাবেদ আলীকে ডাকলেন। সে সব খবর রাখে।
: আচ্ছা ছাবেদ, একটা রিকশার দাম কত?
: দশ হাজার স্যার।
: দশ হাজার!
চোখ কপালে তুললেন তিনি।
: জি স্যার, তা আপনি রিকশা কিন্যা কী করবেন?
তারপর একটু থেমে নিজেই বলল- ও বুঝছি। আপনাগো গ্রামের যা রাস্তা, গাড়ি তো যায় না! একটা রিকশা ভাড়া কইরা বাড়িত যান।
সহসা বিদ্যুৎ চমকের মতো বুদ্ধি খেলে গেল। তাই তো দুদিনের জন্য একটা রিকশা ভাড়া করে নিলেই চলে। বাচ্চা ছেলে দুদিন পর ভুলেও যাবে ব্যাপারটা।
: খালের পারে কালু মিস্ত্রির গ্যারেজে রিকশা ভাড়া দেয়। ভোরে না গেলে পাওয়া যায় না।
যোগ করল ছাবেদ আলী।
আর কোনো কথা বাড়ালেন না তিনি। রোজকার মতো পরদিন ভোরে হাঁটতে বের হলেন। এ ছোট শহরে মেইন রোড বলতে একটাই। খালের পার দিয়ে তা চলে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে কালু মিস্ত্রির গ্যারেজ পেয়ে গেলেন। কালু সবে ঘুম থেকে উঠেছে। দামদর করে ভাড়া নিলেন সুন্দর ঝকমকে নতুন একটা রিকশা।
: কিন্তু কে পৌঁছে দেবে?
: নয়টার পর লোক পাইবেন স্যার।
কালু বলল। না, না, এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবেন না। আটটায় অফিস। জীবনে কখনো লেট হননি। তারপর যেই মনে পড়ল আজ রাকিবের জন্মদিন। তখন নিজেই উঠে বসলেন চালকের সিটে। রাকিবকে সারপ্রাইজ দিতে হবে। তাছাড়া সাইকেল চালিয়ে তার অভ্যাস আছে। এত ভোরে কেউ দেখবে না। এ সময়ের তাজা বাতাসে এক অন্য রকমের আনন্দ লাগছে। হঠাৎ এক দম্পতি হাত তুলল-এই রিকশা, যাইবা?
যদি চিনে ফেলে তাই লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন- না।
জোরে প্যাডেল চালালেন এবার। কিন্তু ভাগ্য খারাপ। একটু পর চেইন পড়ে গেল। থামতে হলো চেইন ঠিক করতে। দেখলেন একজন তরুণ মুচকি হেসে তার ছবি তুলছে। তাড়াতাড়ি চেইন তুলে শাঁ শাঁ রিকশা চালিয়ে বাড়ি চলে এলেন তিনি। রিকশা দেখে রাকিব উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। রাকিবের মা মাথা চাপড়াতে লাগলেন- হায়, হায়! আমার জামাই শেষে রিকশা চালায়!
পরদিন পত্রিকায় খবর বের হলো- ডাক্তারি ছেড়ে রিকশাচালক। সেই সঙ্গে তার রিকশা চালানোর ছবি। সিভিল সার্জন ডেকে পাঠালেন তাকে।
: প্র্যাকটিস হয় না বলে কি রিকশা চালাবেন? আপনি সমস্ত ডাক্তার সমাজের সম্মান ডুবিয়েছেন। চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েশন আপনাকে সাসপেন্ড করে মানসিক চিকিৎসার জন্য পাবনায় পাঠাতে সুপারিশ করেছে। আমি ডিজিকে বলে দয়া করে আপনাকে শুধু ট্রান্সফার করে দিলাম। এ রকম ডাক্তার আমার জেলায় রাখব না।
মুখ কালো করে তিনি ভাবলেন, রাগের মাথায় একটা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এত বড় খেসারত দিতে হলো!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper