ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দাদুর চশমা

শাহেদ জাফর হোসেন
🕐 ২:১৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২১

দাদুর চশমা

আরিফ তার দাদুকে কোনোদিন দেখেনি। তবে দাদুর ছবি সে দেখেছে তাদের বসার ঘরে টাঙানো থাকতে। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আরিফ মাঝে মাঝেই দাদুর সঙ্গে কথা বলে। দাদু কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করে। আরিফের দাদু আবদুল মজিদ হক ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তার দাদু একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ভাবতেই গর্ববোধ হয়। আবার যখন দেখে তার দাদি রশিদা বেগম দাদুর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তখন খারাপ লাগে।

দাদুর স্মৃতি বলতে ঘরে তেমন কিছু নেই। দাদি তার আলমারিতে দাদুর একটি চশমা, পাঞ্জাবি আর চাদর তুলে রেখেছেন। এগুলোই দাদুর স্মৃতি। পরম যত্নে দাদি এগুলো আগলে রেখেছেন। আরিফের দাদু একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। দাদু যখন শহীদ হন তখন আরিফের বাবার বয়স ছিল এক বছর। তাই বাবাকে কোনোদিন দাদুর কোনো গল্প বলতে সে শোনেনি। আরিফ দাদুর গল্প শুনেছে দাদির মুখে। দাদি তাকে কোলে বসিয়ে কত যে গল্প বলেছে দাদুর।

গল্পগুলো থেকেই আজ ষোল ডিসেম্বরে স্কুলের গল্প বলা প্রতিযোগিতায় শোনাবে। পকেটে করে আরিফ তার দাদুর চশমাটা নিয়ে এসেছে। প্রতিযোগিতায় যখন আরিফের গল্প বলার পালা এসে গেল তখন সবাইকে সালাম দিয়ে সে গল্প বলা শুরু করল-
আমি যে গল্পটা বলব তা আজ থেকে অনেক বছর আগের। এদেশে যুদ্ধ হয়েছিল একবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের। সেই যুদ্ধে অনেকের মতোই অংশগ্রহণ করেছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। সেই মানুষটি শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে লোভনীয় চাকরি না করে নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। তার স্বপ্ন ছিল গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করে তোলা। ভালোই চলছিল দিন। তিনি যখন হাটে যেতেন মাঠে যেতেন তখনো তার সঙ্গে ছাত্ররা ঘুরত। তাকে খুব মান্য করত, ভালোবাসত। সবে সংসার জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। বছর ঘুরতেই জন্ম হয় প্রথম সন্তানের। দেশ যে অশান্ত ছিল সেই গ্রামে থেকেও তিনি তা জানতেন। খোঁজখবর রাখতেন দেশের। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে ছাত্রদের প্রস্তুত হতে বলেছিলেন।

এমনি করেই একদিন রাতে রেডিওতে শুনতে পান দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা। তারপর যুদ্ধ শুরু হয় শহর গ্রাম-গঞ্জে সবখানেই। সারা দেশের মতো তাদের গ্রামেও প্রস্তুত হয় মুক্তিবাহিনী। তিনি হন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। গ্রামে মুক্তিবাহিনী যেমন গড়ে উঠেছিল তেমনি গড়ে উঠেছিল রাজাকার আলবদর বাহিনীও। একরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় তাদের গ্রামে। অপ্রস্তুত ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা।

রাজাকার সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই মানুষটির বাড়িতে। তখন রাত। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। দরজায় টোকা পড়েছিল কয়েকবার। ভাবলেন মুক্তিযোদ্ধারা হয়তো ডাকতে এসেছে। দরজা খুলে দিলেন তিনি। দরজা খুলে চমকে গেলেন। উঠানভর্তি পাকিস্তানি মিলিটারি আর রাজকার বাহিনী! চোখে চশমা আর গায়ে পাঞ্জাবি পরার সময়টাও দিল না তারা। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা তাকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, মাস্টারসাব চলেন। আমাদের সঙ্গে ভালো-মন্দ দুইটা কথা বলবেন নিরিবিলি কোথাও গিয়ে।

মানুষটির স্ত্রী অনেক অনুনয় করল ওদের কাছে তবু তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো না। নিয়ে যাওয়া হলো সঙ্গে করে। তারপর থেকে আজও সেই মানুষটির স্ত্রী অপেক্ষা করেন স্বামী ফিরবেন বলে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। পরে মুক্তিযোদ্ধার খোঁজখবর নিয়ে এসে জানিয়েছিল সেই রাতেই তাকে বিলের ধারে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল।

আরিফের গল্প বলা শেষ হয়। গল্প বলা শেষ হলে সে তার সামনে থাকা মাইকে বলে এতক্ষণ যে মানুষটার গল্প বললাম তার নাম আবদুল মজিদ হক। তিনি আমার দাদু।

আরিফের গল্প শুনে হলভর্তি দর্শক দাঁড়িয়ে যায়। সবাই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
আরিফ তার পকেট থেকে একটি চশমা বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, চশমাটি আমার দাদুর চশমা। এতদিন এটি আমাদের কাছে স্মৃতি হিসেবে ছিল। এই চশমা আমি আমার দাদির সম্মতিতে স্কুলের মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালায় দিতে চাই।

সবাই আবারও করতালি দেয়। আরিফের দাদুর চশমাটা এখন থেকে সবার। আরিফের দাদুও যে এদেশের সবার।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper