প্রজাপতির রঙিন ডানায় নাহিদা
মনিরা মিতা
🕐 ২:১১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২১
পাকা রাস্তার পাশেই শিমুল গাছটি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের ওর পাতাগুলো থিরথির করে কাঁপছে। গাছের কাঁটাগুলো যেন সবাইকে সাবধান করে বলে- অন্য গাছের মতো অকারণে আমার ডাল ভাঙতে এলে খবর আছে। পড়ন্ত বিকালে দ্বৈতের মতো নিজের ছায়া দেখে মিটমিট করে হাসে গাছটা। নিজের লাল টকটকে ফুল দেখে ওর গর্বে বুক ফুলে ওঠে। লাল ফুলগুলো হয়ে ওঠে আরও লাল।
এই ফুলগুলো নিয়েই নাহিদা, নাবিলা, অনিক, আসাদ খেলা করে। ওরা সবাই চাচাত ভাইবোন। শিমুল গাছের নিচে রাখা বালুর ঢিবির ওপর সবুজ পাতা, লাল ফুল, ইটের খোয়া এসব নিয়ে খেলা চলে ওদের।
রাস্তার পাশেই ওদের বাড়ি সুতরাং খেলার জন্য এটাই তাদের একমাত্র জায়গা। প্রতিমুহূর্তে বড় বড় গাড়ি সাঁই-সাঁই করে ছুটে চলে রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝে রোড অ্যাকসিডেন্ট হয়। আহত মানুষের কান্না আর আহাজারিতে ভরে ওঠে পুরো এলাকা। হঠাৎ তীব্র কোনো শব্দ হলে আঁতকে ওঠে এলাকার মানুষ। তড়িঘড়ি করে ছুটে আসে রাস্তায়। আগে এই রাস্তা কাঁচা ছিল কিন্তু উন্নয়নের ছোঁয়ায় এখন পাকা হয়েছে।
আজ সকাল থেকে খেলতে খেলতে বেলা হয়ে গেছে। আসাদ বলে, ‘কী রে আজ কেউ স্কুলে যাবি না?’
‘ও তাই তো।’
‘চল। সবাই স্কুলে যাই কিন্তু স্কুল থেকে ফিরেই সবাই এখানে চলে আসবি।’
‘ওকে। বস।’
অনিকের কথায় সবাই হেসেই কুটিকুটি হয়।
ওরা দল বেঁধে স্কুলে যায়। যাওয়ার পথে প্রজাপতি হয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায়। হাত দুটো মেলে ধরে দৌড়ে চলে ওরা।
পথের শুকনা সুপারি পাতা দেখলেই একজন চড়ে বসে আর বাকিরা টানতে থাকে। কী মজার সে খেলা! এভাবেই চলে তাদের স্কুল অভিযান। আজ স্কুলে যাওয়ার সময় নাহিদা তার দাদির কবরের পাশে থমকে দাঁড়ায়। গত মাসে মারা গিয়েছে তার দাদি। ক্লাস ওয়ানে পড়া ছয় বছরের ছোট্ট মেয়েটি ওখানে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবে। আসাদ ওকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘কী রে, দাঁড়ালি যে! নিজের স্কুলে যাবি না?’
নাহিদা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বড় মানুষের ভঙ্গিতে বলে, ‘একদিন আমাদের সবাইকে মরতে হবে। দাদির মতো কবরে থাকতে হবে। কবরটা খুব অন্ধকার, ওখানে থাকতে খুব কষ্ট তাই না ভাই?’
নাহিদার কথায় কিছুটা চমকে ওঠে সাত বছরের আসাদ। চোখ বড় বড় করে ছোট বোনকে দেখে। বিকালে স্কুল থেকে ফিরেই খেলতে আসে নাহিদা, অনিক আর আসাদ। ওদের দেখাদেখি আরও কয়েকজন এসে জুটেছে। বালির ওপরে বসে গাড়ি-গাড়ি খেলছে ওরা। এমন সময় নাহিদা বলে, ‘তোরা খেল, আমি দোকান থেকে চানাচুর কিনে আনি। এই যাব আর আসব।’
নাহিদা এক লাফে রাস্তার কিনারায় চলে যায়। পেছন থেকে আসাদ বলল, ‘সাবধানে যাস।’
একথা শুনে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে পেছনে ফিরে নাহিদা বলে, ‘কিচ্ছু হবে না। আমি এক্ষুণি আসছি, তুই শিমুল ফুল কুড়িয়ে রাখ। এসে মালা বানাব।’
নাহিদা দোকানে গিয়ে প্যান্টে গুঁজে রাখা দুই টাকার নোট বের করে। ওর আব্বা আজ টাকাটা দিয়েছে।
নাহিদা এক টাকা দিয়ে চানাচুর কিনে আর বাকি এক টাকার কয়েন আবার গুঁজে রাখে। চানাচুর খুব পছন্দ ওর। খেতে খেতে খেলার সাথীদের দিকে তাকিয়ে হাসি দেয় নাহিদা। হাসিমুখে রাস্তা পার হতে থাকে। আসাদ অনেকগুলো ফুল কুড়িয়ে বোনের আসার অপেক্ষা করে। কিন্তু এমন সময় বিকট একটা শব্দ, সঙ্গে করুণ আর্তনাদ ভেসে আসে।
মুহূর্তে রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। আসাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কী ঘটেছে বুঝতে পারে না। দুরুদুরু বুকে একপা দু’পা করে সামনে এগিয়ে যায় আসাদ। পুরো রাস্তায় ছড়িয়ে আছে চানাচুর। কালো পিচের ওপরে এক টাকার রূপালি কয়েনটা চকচক করছে।
অনেক মানুষের জটলা। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। কিন্তু আসাদ খুঁজতে থাকে নাহিদাকে। অথচ কোথাও নেই নাহিদা।
অনেক খোঁজ করার পর আসাদের চোখ পড়ে গাড়ির চাকার দিকে। চাকা থেকে গড়িয়ে পড়ছে গরম রক্ত। আসাদের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। ও পিচের ওপর পড়ে যায়, ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা প্রজাপতি উড়ে আসে। প্রজাপতিটা আসাদের হাতে বসে আলতো করে পাখা নাড়ে। ভীষণ সুন্দর নকশা করা দুটি পাখা। প্রজাপতি নাহিদার খুব পছন্দ ছিল, ও বলত- আমি একটা প্রজাপতি হতে চাই। আসাদের মনে হলো, এটা আসলে প্রজাপতি না, নাহিদা।
এত বছর পর নাহিদার স্মৃতি মনে পড়ে চোখ ভিজে যায় আসাদের। দাদির কবরের পাশে নাহিদা শুয়ে আছে পরম শান্তিতে। হঠাৎ আসাদ দেখতে পায় একটা প্রজাপতি নাহিদার কবরের ওপর পাখা মেলে বসে আছে। রোদে ওর পাখা দুটি জ্বলজ্বল করছে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228