ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘আদর্শ সাহিত্য শিশুর মননকে সমৃদ্ধ করে’

ফারুক হোসেন
🕐 ১:০৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০২০

এখনকার শিশুসাহিত্য চর্চা কেমন হচ্ছে?
এখন সময়টা সাহিত্যচর্চার। শিশু সাহিত্যচর্চায় একটা স্রোত কাজ করছে। সবাই লিখছেন, গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করছেন। প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। চারদিকে একটা হৈ চৈ ভাব আছে, প্রতিযোগিতার প্রবাহ বইছে। সাহিত্য নিয়ে চলছে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান, আলোচনা, প্রকাশনা উৎসব, মতবিনিময়। যুক্ত হচ্ছেন দুই দেশের বাংলা শিশুসাহিত্যিকরা। তৈরি হচ্ছে ছড়া ও গল্পের অ্যানিমেশন। প্রকাশকরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই ভেবে, সামনের মেলা আসার আগেই স্বাভাবিক হবে সব। এই যে এতসব হচ্ছে তাতে শিশুসাহিত্য ও সাহিত্যিকরাই সবচেয়ে সরব। আমি বলব, কোভিড-১৯ শিশুসাহিত্যের চর্চায় গতি এনেছে।

উল্লেখযোগ্য শিশুসাহিত্যিক কারা; কী বৈশিষ্ট্যে তাদের শনাক্ত করবেন?
আমি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকের চেয়ে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকে আগে বিবেচনা করি। কেউ একটি লিখে উল্লেখযোগ্য। কেউ অনেক লিখে। আবার কেউ লিখেই যাচ্ছেন, উল্লেখযোগ্য হতে পারছেন না। সে জন্য নাম বলা কঠিন। তবে আমরা যদি চোখ রাখি সাহিত্যের মাঠে, বুঝতে পারব কারা উল্লেখযোগ্য। অনেকে আছেন যারা তার একটি স্বতন্ত্র সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছেন, লেখার ভিন্নতা দিয়ে, নতুনত্ব এনে, অর্থবোধ ও বিষয়ে চমক দিয়ে, তারাই উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্যকে আমি শনাক্ত করি, শুধু পাঠের মাধ্যমে। সেদিন একটি ছড়া পড়লাম, ব্রত রায়ের, মায়ের কোনো ছুটি নেই। অসাধারণ লাগল। আবার অন্যের কাছে সেটি অসাধারণ নাও হতে পারে। তাই শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যও আপেক্ষিক।

আপনার প্রথম শিশুতোষ বই কোনটি; পাঠক কীভাবে গ্রহণ করেছিল?
আমার প্রথম শিশুতোষ গ্রন্থ ‘লুটোপুটি’। ছড়ার। প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৪ সালে, গ্লোব লাইব্রেরি থেকে। বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সৈয়দ ইকবাল। সতীর্থরা বলেন, আমি এ পর্যন্ত যত লিখেছি, লুটোপুটিই নাকি শ্রেষ্ঠ। আর পাঠকদের কথা না-ই বললাম। বইটি পেয়েছিল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সাহিত্য পুরস্কার। সব মিলিয়ে বলতে পারি, বইটি প্রথম সন্তানের মতো আমার লেখার সত্তাকে নেতৃত্ব দিয়েছে, সবাইকে আপন করে নিতে পেরেছে। পাঠকরাও অকৃত্রিম সাড়া দিয়েছে বইটির লেখা পড়ে।

শিশুসাহিত্যিক হয়ে ওঠার নেপথ্যে কী অনুপ্রেরণা ছিল?
আমার ভেতরে লেখক হয়ে ওঠার যন্ত্রণা ছিল। নানা কিছু লিখে গেছি ১৯৭৮ পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৯-তে যুক্ত হওয়ার পর বুঝতে পারলাম সাহিত্যের নানা বিভাগ আছে। আমার কাছে ভালো লাগল ছড়া। ছড়া লিখে পেলাম হাততালি ও প্রশংসা। আর তাকে ধরে রাখতে আরও আরও লিখলাম। ভেতরে জেদ সৃষ্টি করেছেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও আফলাতুন। লেখা নির্বাচিত হওয়ার কঠিন বৈতরণী দেখে। উৎসাহ পেয়েছি কিশোর বাংলা টিমের কাছে। রফিকুল হক দাদুভাই প্রধান। এভাবে যাত্রা শুরু হলেও আর থামেনি। দেখলাম শুধু ছড়া নয়, গল্প, ভ্রমণ রচনা, প্রবন্ধও লিখে ফেলেছি। ছোটদের জন্য। এভাবেই আমি হয়ে উঠেছি লেখক। শিশুদের জন্যও লিখি বিধায় আমারও নামকরণ হলো শিশুসাহিত্যিক।

একজন আদর্শ শিশুসাহিত্যিকের কী গুণ থাকা উচিত?
শিশুদের জন্য লেখা কঠিন। তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে লিখতে হবে। তাদের বিপথগামী করতে পারে এমন বিষয়, বাক্য, শব্দ, উক্তি-পরিহার করতে হবে। অনেক শীর্ষ লেখক বলেছেন, সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন বিভাগটি হলো শিশুসাহিত্য। যারা মেধাবী সাহিত্যিক তারা শিশুসাহিত্যও করতে পারেন। আদর্শ শিশুসাহিত্য সেটিই যেটি শিশুর মননকে সমৃদ্ধ করবে ইতিবাচক ধারায় এবং তার মনে সাড়া জাগাতে পারবে মানবিক গুণাবলি নির্মাণে ও পরিপূর্ণ ভালো মানুষ হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা জোগাবে যে সাহিত্য। আর এই সাহিত্য যিনি উপহার দিতে পারবেন, তিনিই আদর্শ শিশুসাহিত্যিক।

শিশুর মানস গঠনে সাহিত্য পাঠ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কতটা জরুরি?
অত্যন্ত জরুরি। বই পড়া, বইয়ের পাতা স্পর্শ করা, বই বুকের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়া, বইয়ের কাহিনী পড়ে মন খারাপ করা, কান্না করা, হাসাÑ এই সব শিশুদের মনকে বিশুদ্ধ করে। সেটি সফট নয় হার্ড ফরমের বই দিতে হবে, তা ছুঁয়েই তার ভেতর জেগে উঠবে শুদ্ধ প্রাণ। সকল সাংস্কৃতিক কর্মকা- একই ধারায় শিশুদের অনিয়ম, অন্যায়, অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে রাখবে। গড়ে উঠবে তার মানবিক মন।

অতীতের জনপ্রিয় শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো নিষ্ক্রিয়; বর্তমানেও শিশুবান্ধব সংগঠন সৃষ্টি হচ্ছে না। এটা ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলতে পারে?
এটা খুবই দুর্ভাবনার বিষয়। শিশু-কিশোর সংগঠন ছিল বলেই দেশে একটি শক্তিশালি শিল্প সংস্কৃতির কাঠামো আছে। এটি ভবিষ্যতেও প্রয়োজন। একদিকে তথ্যপ্রযুক্তি শিশুদের সরিয়ে নিচ্ছে মৌলিক সংস্কৃতি চর্চা থেকে, অন্যদিকে ওদের আকর্ষণ করার মতো শিশু সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ম্লান হয়ে গেছে, শিশুদের টানতে পারছে না। শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠবে, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকবে, বিচ্ছিন্নতা তার ভালো লাগবে, সে অনেক কিছু জানবে কিন্তু তার প্রকাশ বা পারফরমেন্স করতে পারবে না। একটা দৃপ্ত নাগরিক সমাজ গঠন থেকে মানুষ ক্রমেই সরে যাবে।

স্মৃতিতে উজ্জ্বল ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকার শিশুপাতা কোনগুলো? বর্তমানে দৈনিকগুলোর শিশুপাতার আয়োজন ও কার্যক্রম নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট আপনি?
স্মৃতিতে উজ্জ্বল পাতাগুলো ছিল, দৈনিক ইত্তেফাকের রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সম্পাদিত ‘কচি-কাঁচার আসর’, দৈনিক বাংলার আফলাতুন সম্পাদিত ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং দৈনিক সংবাদের বজলুর রহমান ভাইয়া সম্পাদিত ‘খেলাঘর’। আর ম্যাগাজিন, বিপ্রদাশ বড়–য়া সম্পাদিত ‘শিশু’, আবদুস সাত্তার সম্পাদিত ‘নবারুণ’ ও সেলিনা হোসেন সম্পাদিত ‘ধান শালিকের দেশ’। আর সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’, সম্পাদক ছিলেন রফিকুল হক দাদুভাই। পত্রিকাটি যে কী রকম জনপ্রিয় ছিল তা তখনকার কিশোর বাংলা প্রেমিকরাই একমাত্র মনে করতে পারেন। তখন একটি দৈনিকের মতোই ঘরে ঘরে নিয়মিত রাখা হতো কিশোর বাংলা।
বর্তমানে বেশ ক’টি পাতা আমাকে আকর্ষণ করে। লিখতে অনুপ্রাণিত করে। উল্লেখযোগ্য পাতাগুলো হচ্ছে, ঘটাংঘট, এলেবেলে, ইচ্ছেডানা, ঘাসফড়িং, ডানপিটে, ঝিলিমিলি। গোল্লাছুট-এর আয়োজনটি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ছোটদের লেখার পাশাপাশি ছোটদের জন্য লেখা থাকতে হবে। তা না হলে লেখক ও ছোট পাঠকের মধ্যে/ ছোট লেখকের মধ্যে বন্ধন রচনা হবে কী করে! কচি-কাঁচার আসর এখন ভালো হচ্ছে। এটা বলতেই হবে, এখন প্রায় সব পাতাই ভালো সম্পাদকদের হাতে পড়েছে। তবে সবাইকেই সুনির্দিষ্ট নীতি ঠিক করে চলতে হবে যাতে প্রতিষ্ঠিত লেখকের প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে এবং এই পাতা থেকেই নতুন লেখক সৃষ্টি হতে পারে। সংগঠন যখন নেই অথবা সক্রিয় নয়, তখন পাতাকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। কিশোর বাংলার একটা নীতি ছিল। তা হলো, ‘তোমাদের জন্য লেখা’ আর ‘তোমাদের লেখা’। এই নীতিতে প্রতিষ্ঠিত আর নতুন লেখকের মধ্যে পরিচয় হতো।

শিশুর মনোজগতে বর্তমানে রচিত ছড়া কতটুকু আলোড়ন তুলতে সমর্থ হচ্ছে?
শিশুর মনোজগতে বর্তমানে রচিত ছড়া অবশ্যই আলোড়ন তুলছে। এখন ছড়া বিষয় সমৃদ্ধ ও সহজে বোধগম্য। যে শিশুকে আমরা অভিভাবকরা ছড়া পড়তে দিয়েছি, তারাই শুধু বলতে পারবেন সেটি শিশুর মনে রেখাপাত করেছে কি-না। আগুনকে মোমের কাছে আনতে হবে, তাহলেই বুঝব মোম গলছে কি-না। সাধারণভাবে দেখুন, গত ১০ বছরে আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তি, বঙ্গবন্ধু, রাসেলকে নিয়ে যত ছড়া লেখা হয়েছে, তা তো আমাদের শিশুদের মনে রেখাপাত করেছে। কী করে বুঝব? শিশুরাও রাসেলকে নিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার চেষ্টা করছে। ছবি আঁকছে।
লেখা পড়তে দিতে হবে, তাহলেই বুঝব সেটা কতটা আলোড়ন তুলেছে।

লেখালেখিতে উৎসাহীদের কী পরামর্শ দেবেন?
নবীনদের প্রতি আমার অনুরোধ, লেখার শিল্পমান যাতে ক্ষুণ না হয় সেদিকে সবচেয়ে বেশি যতœবান হতে হবে। নতুনত্ব আনতে হবে, স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। সে জন্য লেখার ভূমিরেখা (ইধংবষরহব) জানা থাকতে হবে। আর এই কারণেই পড়তে হবে। পড়তে হবে সব নয়, নির্বাচিত এবং বাছাই করা লেখাগুলো। বাছাই করা লেখকের। যারা একটি বেজলাইন তৈরি করে রেখেছেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ
শফিক হাসান

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper