দীপু নাম্বার টু
কিশোর স্মৃতির ফুল
জাহানারা আক্তার ইতি
🕐 ৪:৩৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৮, ২০১৮
-আসতে পারি?
-না।
-তাহলে কি পরে আসব?
-তোকে আর আসতেই হবে না।
কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে ক্লাসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রাঙ্গামাটি জিলা স্কুলে সদ্য অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মুহম্মদ আমিনুল ইসলাম হক ওরফে দীপু হঠাৎ বুঝে গেল রোলকল করতে থাকা রাশভারী শিক্ষক আসলে তার সঙ্গে মজা করছেন।
ছোটবেলার স্মৃতি মানে বেড়ে ওঠার সময়কার বন্ধুরা, খেলার সাথীরা আর ক্লাসের ফাঁকে খুনসুঁটি, টিফিনের সময় বন্ধুর খাবার নিয়ে লুকোচুরি, ফুটবল কিংবা ডাংগুলি খেলা, দুরন্তপনা, দুষ্টুমি কোনো কিছুই বাদ যায় না। একঝাঁক বন্ধুত্বের গল্পে ভরপুর, দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ একটি স্মৃতির নাম ‘দীপু নাম্বার টু’।
নব্বই দশকে জন্ম নেওয়া প্রায় প্রতিটি শিশুর জীবনের একটা সময় পর্যন্ত তার সবচেয়ে প্রিয় চলচ্চিত্রের স্থানটি দখল করে রাখে ‘দীপু নাম্বার টু’। ‘দীপু নাম্বার টু’ চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রে ছিল অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া দীপু নামের বেশ গম্ভীর একটি ছেলে। ক্লাসে আরেকটি দীপু থাকায় তার নামের পেছনে ‘টু’ লাগিয়ে তাদের পৃথক করা হয়। যাতে করে একজন অঙ্কে ভুল করলে অন্যজন মার না খায়। এদিকে একই ক্লাসে পড়া বয়সে বড় এক বখাটে ছেলে তারিককে ক্লাসের সবাই ভয় পায়। অন্য সবার মতো দীপুর ওপরও দাপট দেখাতে চাইল তারিক। তবে দীপু ক্লাসের অন্য সবার মতো ছিল না। তাই সে তারিকের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলতে লাগল। বিনিময়ে মার খেতেও হলো দীপুকে। তবে সে-ও কি কম যায়? দীপু চুপিচাপি অপেক্ষা করতে লাগল তারিককে তক্তা বানানোর জন্য। কিন্তু এখানে এসে গল্পের মোড় বদলে যায় এবং বোধহয় গল্পের সবচেয়ে সুন্দর বাঁক এটিই! এই মোড়ে এসেই গল্পটি হয়ে যায় দীপু ও তারিকের বন্ধুত্বের। ঘটনাক্রমে একদিন তারিক ও দীপু জীবনবাজি রেখে অন্য এক বন্ধুকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে। তক্তার বদলে তারিক হয়ে যায় সবচাইতে প্রিয় বন্ধু! সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বও বাড়তে থাকে। একসময় দীপু জানতে পারে, তাদের দুজনের পারিবারিক জীবনেই কিছু অজানা গল্প আছে যা অন্য কারও সঙ্গে কখনো ভাগ করে নেওয়া হয়নি। দুজন জানতে পারে দুজনের নির্মম বাস্তবতা। দুঃখগুলো যেন বন্ধনটাকে আরও শক্ত ভিত দিয়ে দিল। তারা বুঝতে পারল কিছু জিনিস চাইলেও এড়ানো সম্ভব নয়। আর এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই তারা পথ চলতে থাকে। অভিযান ভালো লাগে তারিকের, যখন-তখন খুঁজে বেড়ায় পুরনো নিদর্শন, অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিকের মতোই! সে দীপুকে একটি কালাচিতা উপহার দেয়। গল্পের নাটকীয়তা বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধার হয় সে কালাচিতা রহস্য এবং জীবনবাজি রেখে দীপু ও তার বন্ধুরা দেশপ্রেম ও বন্ধুত্বের টানে পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে প্রাচীন সংস্কৃতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে আসে বছর। প্রতিবারের মতো এবারও দীপুকে তার বাবার সঙ্গে অন্য কোথাও চলে যেতে হয়। এর মধ্য দিয়েই বন্ধুত্ব, ত্যাগ, রোমাঞ্চকর অনুভূতি এবং ভালোবাসার নিদর্শন প্রদর্শন করে সিনেমাটি সমাপ্ত হয়।
সিনেমাটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অর্থাৎ দীপু চরিত্রে অভিনয় করেন অরুণ সাহা। চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নেওয়া তখনকার এ খুদে অভিনয়শিল্পী শুধু সে সময়ের দর্শকদেরই মন্ত্রমুগ্ধ করেনি। এখনো যারা সিনেমাটি দেখে, তারাও অরুণ সাহার প্রশংসা না করে পারে না। দীপুর বন্ধু তারিকের চরিত্রে অভিনয় করেন আরেক শিশুশিল্পী শুভাশীষ। গল্পের প্রতিটি মুহূর্তে নিজ দক্ষতায় যেন পরিপূর্ণ বাস্তবতাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন শুভাশীষ। তাই তিনিও যথাযথ প্রশংসার দাবিদার। এ ছাড়া শিক্ষক আবুল খায়ের, দীপুর বাবা বুলবুল আহমেদ, দীপুর মা ববিতা ও দীপুর বন্ধুদের অভিনয়ও ছিল অতুলনীয়। এদের সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসলই এই ‘দীপু নাম্বার টু’ আজও বহু দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর হয়ে আছে, থাকবে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দীপু নাম্বার টু’ পরিচালনা করেছেন দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম। ১৯৮৪ সালে এটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রীয় অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রে কোনো গান না থাকলেও রয়েছে আবহসংগীত এবং এর পরিচালনা করেছেন সংগীত পরিচালক সত্য সাহা।
‘দীপু নাম্বার টু’ বইটিতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘আমি যখন পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি, তখন সেখানে আমি একেবারেই একা। একাকিত্ব দূর করার জন্য আমি তখন কল্পনায় একটা কিশোর তৈরি করে নিয়েছিলাম। তার নাম দিয়েছিলাম দীপু। সেই কিশোর আর তার প্রিয় মানুষদের সুখ-দুঃখ আর অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীটা লিখে নাম দিলাম ‘দীপু নাম্বার টু!’ চলচ্চিত্রটি তোমরাও দেখতে পারো। এমনকি বইটিও পড়ে দেখতে পারো।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228