ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বঙ্গবন্ধু ও মননের গল্প

মামুন সারওয়ার
🕐 ৮:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৩, ২০২০

সকালে ঘুম থেকে উঠে মনন আঁকিবুকি করে। আঁকতে আঁকতে সারা দেয়াল ভরে ফেলে। রঙিন মোমের পেন্সিলে আঁকিবুকি শেষ করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার থেমে থেমে কী যেন ভাবে। কখনও কখনও আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসে অন্য ঘর থেকে। আর বলতে থাকে আম্মু আম্মু পাখি এঁকেছি।

দুটি পাখনাওয়ালা পাখি

দুটি চোখওয়ালা পাখি

দুটি পাওয়ালা পাখি

একটি লেজওয়ালা পাখি।

মননের আম্মু তখন একটি পাখির ছড়া শোনায়।

পাখিটার নাম হল টোনা

কাজ তার শুধু বাসা বোনা

পাখিটার নাম হল টুনি

প্রতিদিন ডালে ডালে তার গান শুনি।

ছড়াটা শুনে মনন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। মনন বলে, পাখিটা কোথায় থাকে? আম্মু তখন বলে, পাখিটা গ্রামে থাকে। পাখিটা দেখতে খুব ছোট্ট। এই বলে আম্মু আরেকটা ছড়া শোনায়।

টুনটুনিটা টুনটুনিয়ে গুনগুনিয়ে

কী যে বলে গানের ছলে

ধুত্তোরি ছাই বুঝি না তো আমি

ডালিম গাছের ডালে ডালে

পাখনা মেলে তালে তালে

উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে

খোলাচুলে করে কি পাগলামি।

মনন আম্মুর মুখে এমন মিষ্টি মধুর ছড়া শুনে বলে আচ্ছা আম্মু, পাখির কি খোলাচুল থাকে? পাখি পাগলামি করে?

তখন আম্মু বলে, পাখি যখন উড়তে থাকে পাখির মাথার পালকগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। তখন মনে হয় পাখির চুলগুলো উড়ছে। আর যখন পাখি এ-ডাল থেকে ও-ডালে উড়ে যায়, তখন মনে হয় পাখি পাগলামি করে।

মনন আম্মুর কথা শোনে চুপচাপভাবে। তারপর বলে, আম্মু, আমি যে পাখিটি এঁকেছি সেটা দেখবে না? আম্মুর হাত ধরে নিয়ে যায় বসার ঘরের দেয়ালে আঁকা ছবিটি দেখাতে। বলো তো আম্মু, ছবিটি কেমন হয়েছে?

আম্মু বলে, অনেক সুন্দর হয়েছে। মিষ্টি একটি দোয়েল পাখির মতো হয়েছে। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি। এ পাখিটির রং সাদা কালো। এরা খুব মিষ্টি সুরে লেজ উঁচিয়ে গান করে।

মনন এবার বলল, আম্মু আব্বুকে বলবে আমাকে অনেক রকম রং কিনে দিতে। সবুজ, লাল, হলুদ, বেগুনি, গোলাপি, নীল, সাদা আর যত রং আছে সব। লাল-সবুজ রং আমার খুব ভালো লাগে। আচ্ছা আম্মু বাংলাদেশের পতাকা কে এঁকেছেন লাল সবুজ রঙে? আমি একটি পতাকা আঁকব।

বাসার দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব। শিশু একাডেমির সামনে যে দোয়েল পাখিটা আছে ওরকম একটা দোয়েল আঁকব। আচ্ছা আম্মু রাতের বেলা দোয়েল পাখিরা কোথায় থাকে? ওদের বাসা আছে? ওরা কি আরাম করে আমাদের মতো ঘুমাতে পারে। ওদের পড়ার টেবিল আছে। সকাল বেলা নাস্তা করে? আমার মতো স্কুলে পড়তে যায়?

আম্মু, আম্মু আমাদের স্কুলে মার্চ মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান হবে। সেখানে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা হবে। ম্যাডাম বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকতে হবে। আমিও ছবি আঁকব। আচ্ছা আম্মু, বঙ্গবন্ধু কে ছিলেন? শতবর্ষ কী?

মননের আম্মু বলেন, এক সময় আমাদের দেশটা অন্যদের মানে পাকিস্তানিদের অধীন ছিল। পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে সবসময় অন্যায় আচরণ করত। আমাদের উপর অত্যাচার চালাত। আমাদের শিক্ষার সুযোগ দিত না, চাকরি থেকে বঞ্চিত করত। আমাদের এখান থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে ওদের নিজেদের উন্নয়ন করত, আর আমাদের কষ্টে জীবন অতিবাহিত হতো।

এমনকি ওরা আমাদের মুখের ভাষা পর্যন্ত কেড়ে নিতে চেয়েছিল। নির্বাচনে আমরা জয়ী হলেও আমাদের দেশ শাসনের সুযোগ দেয়নি। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তিনি দেশকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতার ডাক দেন। ওনার ডাকে দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

মনন অবাক হয়ে মায়ের কথা শুনতে থাকে। মা একটু থামেন। মনন বলল, তারপর? মা বলতে থাকেন তারপর নয় মাসের যুদ্ধ শেষে আমাদের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমরা পাই লাল সবুজ পতাকা। আমরা পাই শ্যামল সুন্দর বাংলাদেশ। যার নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি তিনিই হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন তবে তার বয়স হত এক’শ বছর। আর এ বছরটিকে স্মরণীয় করতে আয়োজন করা হবে অনেক অনুষ্ঠান। শতবর্ষ মানে এক’শ বছর।

আমাদের স্কুলেও শতবর্ষ উপলক্ষে অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। স্কুলে হবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা ও আলোচনা অনুষ্ঠান। শতবর্ষ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বড় বড় কবিরা আসবেন। কবিতা পড়বেন। আমাদের সঙ্গে উনি গল্প করবেন। রিনা ম্যাডাম বলেছেন, সব ছাত্রকে কবি অটোগ্রাফ দেবেন। উনি প্রধান অতিথি থাকবেন ও অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। আমিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করব, তাই না আম্মু?

আম্মু বলেন, অবশ্যই অংশগ্রহণ করবে মনন বাবু। এরই মধ্যে বাবা মননের জন্য ছবি আঁকার অনেক কাগজ ও রং পেন্সিল কিনে আনেন। মনন একেক দিন একেক বিষয়ে ছবি আঁকে। কখনও নদীর ছবি, কখনও হেমন্ত ঋতুর ছবি আবার কখনও ফুল-পাখির ছবি। ক্যালেন্ডারের আঁকা ছবি দেখে। কখনও নিজেই ছবি আঁকে। পাশের বাসার ফরিদা আন্টির কাছে গিয়ে ছবি আঁকা শিখে আসে। ফরিদা আন্টি মানে ফরিদা জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার অধ্যাপক। তিনি মননকে খুব উৎসাহ দেন। শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ছবি আঁকার বইগুলো মননকে উপহার দেন। ওসব দেখে মনন ছবি আঁকে। ছোট ছোট কাগজে ছবি এঁকে পড়ার টেবিলে, দেয়ালে এঁটে রাখে। মা এসব মননকে খুব আদর করে দেন। মাঝে মাঝে ছবি আঁকার ছড়া শোনান।

মনন বাবু ছবি আঁকে খাতার পাতা ভরে

পুকুর ছাড়া মাছ এঁকে দেয় তুলিতে ভর করে

খোলা মাঠে সবুজ ঘাসে এঁকে দিয়ে গরু

হলুদ সবুজ রং মিশিয়ে আঁকতে থাকে মরু

মনন হেসে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা আম্মু, মরু কী?

আম্মু বলেন, যেখানে ধু ধু বালু। কোনো গাছপালা নেই। সেখানে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তাকেই মরুভূমি বলে। সাহারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমির নাম। মা আবার ছড়া বলতে থাকেন

সোঁদর বনের বাঘ আঁকে হলুদ সাদা নীলে

ময়না আঁকে যায় উড়ে সে ডানায় আঁচড় দিলে

আঁকা যখন শেষ হয়ে যায় বলে মনন খোকা

কী এঁকেছি কী এঁকেছি হয়নি আঁকাজোঁকা।

ছড়া শুনে মনন হেসে কুটিকুটি। আম্মু তুমি কি আমাকে নিয়ে ছড়া বললে?

কয়েক দিন পরেই আসে সতের মার্চ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। আর এ বছরের এ দিনেই মহান মানুষটির জন্মের এক’শ বছর পূর্ণ হল। এ দিন মননদের স্কুলে শতবর্ষ অনুষ্ঠান। স্কুলের চারপাশ নানা রঙের কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের পোস্টার লাগানো হয়েছে। স্কুলে উৎসবের আমেজ। আজ স্কুলে এসেছেন বড় বড় কবি। চলছে কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা ও দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। মনন ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ক গ্রুপে অংশগ্রহণ করে। কাগজে ছবি আঁকতে থাকে সে।

দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির মোট পঁচিশ জন ছবি আঁকায় অংশগ্রহণ করে। বিকেলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভা। মনন ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় ক বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে। ওর হাতে তুলে দেওয়া হয় অনেকগুলো রঙিন বই। বইগুলো সুন্দর একটি প্যাকেটে মোড়ানো। মনন বইগুলো পেয়ে খুব খুশি হয়। পুরস্কার পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায়।

ভাবতে থাকে কখন বাড়িতে যাবে। এর মাঝে শুরু হয় প্রধান অতিথির ভাষণ। তিনি বলেন, মধুমতী নদীর কোল ঘেঁষে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। সেখানেই জন্ম হয়েছিল এক ছোট্ট শিশুর। বাবা-মা আদরের সন্তানটির নাম রাখলেন খোকা। প্রকৃতি আর প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে শিশুটি বেড়ে উঠতে লাগল। ছোট্ট শিশুটির ছিল বিশাল হৃদয়। তাই নিজের গায়ের জামা খুলে যার জামা নেই তাকে দিয়ে দেয় পরম মমতায়। গোলার ধান বিলিয়ে দেয় অন্যের প্রয়োজনে। সেই অকুতোভয় কিশোরটি এক সময় বাঙালি জাতির আশ্রয় হয়ে ওঠে। সেই খোকাই আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি এ দেশের মাটি ও মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন। ভালোবেসেছেন শিশুদের। তিনি ছিলেন সরল আর নিরহঙ্কার। তিনি এত বড় নেতা হয়েও খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে তাকে বারবার জেল যেতে হয়েছে। তোমরা নিশ্চয়ই তার সাত মার্চের ভাষণের কথা শুনেছ। সেদিন তিনি রেসকোর্স ময়দান মানে এখন যেটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানÑ সেখানে উদাত্ত কণ্ঠে পরাধীন জাতির উদ্দেশ্যে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনÑ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের প্রিয় নেতা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিনিয়ে এনেছিলাম প্রিয় স্বাধীনতা। আজ স্বাধীন আমাদের চিরসবুজ বাংলাদেশ।

মনন ভাবতে থাকে, এ মহান নেতার কথা। মনে মনে শপথ নেয়, সে পরিচালিত হবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper