সাতপুরুষ
বিলু কবীর
🕐 ৩:২৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০১৯
ধীয়া সামনের বছর ক্লাস ফোরে উঠবে। খুব গুণ তার। লেখাপড়া, খেলাধুলা এবং ছবি আঁকা। সবগুলোয় সে ভালো। ছবি আঁকাটা তার বেশি প্রিয়। খুবই ভালো পারে সে এই আঁকিবুঁকির কাজটা। শহীদ মিনার, জাতীয় পতাকা, ইলিশ মাছ, শাপলা ফুল আর কত কি। গ্রাম, নদী, ইশকুল এসবও। ওর আম্মু শাহানা বানু।
কুষ্টিয়া শহরের একটা কলেজের শিক্ষক। তার সঙ্গেই থাকে ধীয়া এবং বড় বোন হিয়া। কোর্টপাড়ায় মীর মশাররফ হোসেন ইশকুলের কাছে ওদের বাসা। বাবা ঢাকায় থাকে। মাসে-মাসে আসে, এক-দুইদিন থেকে আবার চলে যায়। ধীয়া আম্মুর খুব নেওটা। শাহানা বানু দুই মেয়েকে বুকের ভেতর আগলে রাখে। ধীয়া সময় পেলেই রঙ-পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে বসে যায়। কেবলই ছবি আঁকা। পত্রিকায় ছাপানোর জন্য কীভাবে ঢাকায় ছবি পাঠাতে হয়, ছোটদের পাতার সম্পাদককে চিঠি লিখতে হয় সেটাও সে আম্মুর কাছ থেকেই শিখেছে। একদিন দুপুরে আসল সময়। ধীয়া তার মা-কে জিজ্ঞেস করল-
: আচ্ছা আম্মু, তোমার সবচাইতে প্রিয় গান কোনটি?
আম্মুর জবাব খুব সোজা
: ‘আমার সোনার বাংলা’
: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’র চাইতেও?
এবার প্রশ্নটি কঠিন মনে হয় শাহানা বানুর কাছে। ধীয়া আরেকটু বড় হলে ওকে বুঝিয়ে বলা যেত কোন গানটি কেন এবং কী ধরনের গুরুত্বপূর্ণ। আম্মু অনেকটাই যেন আটকে যায়।
: অ্যাঁ, মানে দুটো গানই আমার খুব প্রিয়। আমার মানে সব্বারই। ‘সোনার বাংলা’ হলো আমাদের জাতীয় সংগীত। আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে’ জাতীয় সংগীত নয়, তবে তারও অনেক ইতিহাস। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হওয়ায় এখন সারা পৃথিবীতে এই গানটির মর্যাদা আরও বেড়ে গেছে।
আম্মুর কথা শেষ হতেই ধীয়া বলল-
: ‘সোনার বাংলা’তো লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আম্মু আঁচ করতে পারে ধীয়া এবার কোন প্রশ্নটি করবে। অতএব সে আগেই জবাবটা দিয়ে দেয়।
: হ্যাঁ। আর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটা লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। এই গানটির সুর দিয়েছেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। দু’জনের বাড়িই বরিশাল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে তারা ঘর ছেড়ে বারান্দায় আসে। ও ঘর থেকে কমপ্যুটার ছেড়ে বেরিয়ে আসে হিয়া আপুও। তাকে জিজ্ঞাসা করে ধীয়া-
: হিয়া আপু, তুমি আলতাফ আংকেলের শহীদ হওয়ার গল্পটি বলবে?
জবাব দেয় হিয়া-
: উনি শহীদ হয়েছেন সেটা জানি। শহীদ বুদ্ধিজীবী। কিন্তু ওনার ঘটনাটি আমি ঠিক জানি না।
আম্মু বলল-
: আমিও তার ঘটনাটা পুরোপুরি জানি না। তুমি আজকে বরং অন্য সাত বীর শহীদের গল্প শোনো। আলতাফ মাহমুদের ঘটনাটি আগে আরেকটু ভালো করে জেনে নিই, তারপর শোনাব।
: ঠিক আছে।
রাজি হয়ে গেল ধীয়া। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো ফেলে শুরু করল আম্মু-
: আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সাধারণ মানুষ আছেন, শিশু, নারী সবাই। তো এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাতজন আছেন বীরশ্রেষ্ঠ। হিয়া তাদের সব্বার নাম বলতে পারবে।
হিয়া শুরু করার আগেই ধীয়া প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
: আমিও একজনের নাম বলতে পারব। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ। আমার বাংলা বইয়ে আছে।
হিয়া এ বছর এসএসসি পাস করেছে। গোল্ডেন পাওয়া ছাত্রী সে। গটগট করে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম বলে যেতে লাগল। ঠিক তক্ষণই ধীয়া ছুটে ঘরে গিয়ে পেন্সিল, খাতা এবং তার বাংলা বইটা নিয়ে ফিরে এলো। এসেই সে একটা ছবি আঁকতে শুরু করল। হিয়া আবার প্রথম থেকে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম বলতে থাকে।
: মতিউর রহমান, মহীউদ্দিন জাহাঙ্গীর, মুন্সি আবদুর রউফ, নূর মোহাম্মদ শেখ, মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, তারপর মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং অ্যাঁ, হচ্ছেন গিয়ে মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। এই মোট সাতজন। প্রত্যেক নামের আগে বীরশ্রেষ্ঠ’।
ধীয়া বলল
: না-না, ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ’।
এবার আম্মু তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়-
: ঠিক আছে, তবে শহীদ না বললেও ক্ষতি নেই। কারণ সব বীরশ্রেষ্ঠই শহীদ, সব শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ নন। তো আমি তোমাদের বলি শোনো, তাদের কার কোথায় জন্ম।
নড়েচড়ে বসল হিয়া। ধীয়া ওদিকটায় কান খাড়া রেখে মন দিয়ে এঁকে চলেছে ছবিটা। আম্মু এক নিঃশ্বাসে বলে গেল নামগুলো আর তাদের জন্মস্থান।
: মতিউর রহমান, ঢাকা। মহীউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বরিশাল। মুন্সী আবদুর উরফ, ফরিদপুর। নূর মোহাম্মদ শেখ, নড়াইল। মোস্তফা কামাল, বরিশাল। রুহুল আমিন, নোয়াখালী। আর থাকলেন হামিদুর রহমান, উনার জন্মস্থান হলো চব্বিশপরগনা, পশ্চিমবঙ্গ।
আম্মুর বলা শেষ হতেই বিদ্যুৎ চলে এলো। ‘এসে গেছে,’ বলে উঠল হিয়া। আম্মুও দাঁড়াল। ধীয়া বলল-
: এই দেখো আমি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ছবিটা এঁকে ফেলেছি।
আম্মুতো অবাক। প্রায় হুবহুই এঁকেছে সে। মানুষের মুখ অবিকল করে আঁকা, ফুল-পাখি আঁকার মতো সহজ নয়। তাই সে ধীয়াকে বাহবা দিল।
: গুড। খুব ভালো হয়েছে। লক্ষ্মী মেয়ে।
এই ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ কথাটা প্রতিদিন টেলিফোনে বাবাও বলে। আল্লাদি ঢঙে ধীয়া বলল-
: এই ছবিটি আমি পত্রিকায় পাঠাব।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228