ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তোমাদের বয়সী যোদ্ধা

আসলাম সরকার
🕐 ২:২১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৮

বিজয়ের মাস চলছে। বাবা-মা কিংবা শিক্ষকদের কাছে নিশ্চয়ই শুনেছো, কত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। এটা কি জানো, ওই যুদ্ধে বড়দের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিল অনেক শিশুকিশোরও। ছোট্ট কাঁধে তারা তুলে নিয়েছিল দেশ স্বাধীন করার মতো গুরুদায়িত্ব। আজ তেমন ডানপিটে, সাহসী, দামাল কয়েকজনের গল্পই তোমাদের শোনাবো...

দুরন্ত আবু সালেক
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উচ্চবিদ্যালয়। এই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে আবু সালেক। এমন সময় শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। কে ঠেকায় আবু সালেককে! সীমানা পেরিয়ে চলে গেল আগরতলায়। সেখানে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হচ্ছিল। কিন্তু ও তো একদম ছোট, বাচ্চা! ওকে কেউ-ই নিতে চাইল না। আর তাই শুনে ও তো একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর কান্না দেখে ওকে আর বাদ দিতে পারলেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখালো ছোট্ট আবু সালেক।
আগরতলা থেকে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো মেলাঘর ক্যাম্পে। একদিনের যুদ্ধে বড় বড় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে এলো ছোট্ট আবু সালেক। ছোট্ট কাঁধে তুলে নিল বিশাল এক দায়িত্ব। ক্রমাগত গুলি করতে লাগল পাকবাহিনীর ক্যাম্প লক্ষ্য করে। আর সেই অবসরে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে গেল অন্যরা। কিন্তু আবু সালেক গুলি করা থামাল না। তোপের মুখে পিছু হটল পাকিস্তানিরা।

বীরউত্তম জহিরুল
একাত্তর সালে ওর বয়স মোটে সতেরো বছর। তবু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ও যোগ দিল মুক্তিবাহিনীতে। প্রথমে কুকিতলা ক্যাম্পে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিল। আর সাড়ে তিন মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিল রীতিমতো সেনা কর্মকর্তা হয়েই। জহিরুল যুদ্ধ করছিল ৪ নম্বর সেক্টরে। একবার রাত ৩টায় ওর দলের সঙ্গে কানাইঘাটে এসে পৌঁছলো জহিরুল। পুব মুখে অবস্থান নিলেন জহিরুল। শুরু হলো ভীষণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততেই হবে। ওদের সবার মুখে একই সুর-হয় জিতবো, নয়তো সবাই শহীদ হব। তবু এ লড়াই হারা যাবে না। শেষমেশ যুদ্ধে ঠিকই জয় হলো মুক্তিবাহিনীর। তাই তো তাকে খেতাব দেওয়া হয়েছে বীরউত্তম।

মোজাম্মেল হক
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হলো, মোজাম্মেল হক তখন মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়ত ঢাকার স্টাফ ওয়েলফেয়ার হাইস্কুলে। কুমিল্লা সীমান্ত পেরিয়ে ও চলে গেল মেলাঘর ক্যাম্পে। ছোট বলে মুক্তিবাহিনীতে নিতে চাইল না ভারপ্রাপ্ত অফিসার। অনেক কষ্টে মোজাম্মেল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিল। তারপর প্রশিক্ষণ শেষে চলে এলো ঢাকায়, এম এ লতিফের গ্রæপের একজন গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ শুরু করল।
ওর চাচা আবার আব্দুল জব্বার, মোনায়েম খাঁর বাড়িতে কাজ করতেন। চাচার সঙ্গে মিলে এক ভীষণ পরিকল্পনা আঁটতে লাগল ও। সখ্য গড়ে তুলল মোনায়েম খাঁর বাসার আরও দুই কাজের লোক শাহজাহান ও মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে। অক্টোবর মাসে পর পর দুবার তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো।

আবু জাহিদ
আবু জাহিদ নাম তার। তবে কুমিল্লার মুক্তিযোদ্ধারা তাকে চিনতেন আবু নামে। পড়ত কুমিল্লা জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে। খুব ইচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে যাবে। বাড়ি থেকে অনুমতি মিলল না। শেষে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাল ও। সাঁতরে গোমতী নদী পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়া টিলার কাছে মুক্তি শিবিরে এসে হাজির হলো। সময়টা তখন ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। কম বয়সের কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই ওকে দলে নিতে চাননি। কিন্তু ওর অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানলেন সেক্টর ইস্টার্ন জোনের কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি।
প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন আবুকে। প্রশিক্ষণের পর অপারেশন। অপারেশনে গিয়ে দেশের মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন আবু।

শহীদুল ইসলাম লালু
বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়া আরেক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা লালু। পুরো নাম শহীদুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। টাঙ্গাইলের দামাল কিশোর। অসীম সাহসের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতা করেন। লড়াই করেন গোপালপুর, ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের বেশ কয়েকটি রণাঙ্গনে। অথচ মুক্তিযোদ্ধারা তাকে দলেই নিতে চাননি প্রথমে। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন আর পাকিস্তানি বাহিনীর গোপন খবর এনে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সবচেয়ে কমবয়সী বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন তিনিই। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতির কাছে অস্ত্র জমা দিতে এলেন লালুও। কিন্তু ওই খুদে মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে তো রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ভীষণ অবাক। মঞ্চ থেকে নেমে খুদে লালুকে কোলে নিয়ে মঞ্চে বসালেন রাষ্ট্রপতি।

গোলাম দস্তগীর টিটো
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটোর কথাই ধরা যাক। পুরো নাম গোলাম দস্তগীর টিটো। বিজয় দিবসের মাত্র দুদিন আগে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর এক অপারেশনে শহীদ হয় টিটো। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে তখন লড়াই করছিল টিটো। লড়াইটা হয়েছিল সাভারের আশুলিয়ার জিরাবো এলাকার কলমা গ্রামে। অসীম সাহসের সঙ্গে লড়াই করছিল তখন টিটো। শহীদ হওয়ার আগে টিটো বলেছিল, স্বাধীনতা দেখবে। কিন্তু স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেনি শহীদ টিটো।

কিশোরী পুতুল
রাজশাহী অঞ্চলে পুতুল নামের ১৪ বছরের গ্রাম্য কিশোরী, ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বিভিন্ন অস্ত্র রাখা হতো। মাঝে মাঝে মেয়েটি অস্ত্রগুলোতে লেগে থাকা কাদা পরিষ্কার করে দিত। এক মুক্তিযোদ্ধা মেয়েটিকে শিখিয়েছিল কীভাবে গ্রেনেড চার্জ করতে হয়। এক দিন সেই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎই পাকবাহিনী ও এ দেশীয় দোসর রাজাকার আক্রমণ করে ওই বাড়িতে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষার্থে মেয়েটি ঘরের দোতলা থেকে পরপর দুটি গ্রেন্ড চার্জ করে বসে!
ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত হয়ে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল।

কাদেরিয়া বাহিনীর হালু
এবার শোনাবো খেতাব না পাওয়া এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প। নাম তার হালু। একাত্তরে যুদ্ধের সময় ওর বয়স ষোলো কি সতেরো। বয়স কম হলে কি হবে, এরই মধ্যে ও এলাকার রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের কাছে রীতিমতো ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যোগ দিয়েছে ভয়ঙ্কর কাদেরিয়া বাহিনীতে। প্রায়ই খবর পাওয়া যেত বিভিন্ন অপারেশনে কীভাবে হালু রাজাকার-আল বদরদের একাই মেরে ফেলেছে। এ জন্য অবশ্য ওর পরিবার কেও কম কষ্ট পোহাতে হয়নি। একদিন শোনা গেল, এক বিরাট অপারেশনে মারা গেছে হালু। তবে এমনি এমনিই মরেনি ও মরার আগে একাই ১০-১২ জন পাক হানাদারকে খতম করে গেছে। শুনে তো ওর বাবা-মা-বোন কান্নায় ভেঙে পড়ল। কিন্তু দুদিন বাদে হালু গভীর রাতে বাসায় হাজির!

হাছিন-হাবিবুর
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন নানা বয়সী মানুষ। বড়দের সঙ্গে দেশের জন্য লড়েছেন অনেক কিশোরও। এমনই দুজন শরীয়তপুরের দুই সহোদর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাছিন খান ও হাবিবুর রহমান খান। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণের পর, কুমিল্লার সীমান্ত এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন হাছিন খান। অপর একটি গ্রæপের সঙ্গে শরীয়তপুরে যুদ্ধে অংশ নেন ছোট ভাই হাবিবুর রহমান খান। ৭ মার্চ, ১৯৭১। উত্তাল জনসমুদ্র তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান। স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন কিশোর আবুল হাছিন খান। এরপরই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মনস্থির করেন তিনি। ঢাকা থেকে নিজ বাড়ি বর্তমান শরীয়তপুরের মগর গ্রামে ফিরে অভিভাবকদের কাছে অনুমতি চান যুদ্ধে অংশ নেওয়ার। অনুমতি না মিললেও গ্রামের আরও ১৭ জনকে নিয়ে দলবদ্ধ হন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের জন্য। কুমিল্লার সীমান্ত এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। বড় ভাই হাছিন খানকে অনুসরণ করে যুদ্ধে অংশ নেন ছোট ভাই হাবিবুর রহমান খান।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper