ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গহীন অরণ্যে সৃষ্টির বিস্ময় ‘হামহাম’

মো. তোফাজ্জল হোসাইন, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)
🕐 ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১

গহীন অরণ্যে সৃষ্টির বিস্ময় ‘হামহাম’

সবুজেঘেরা চা বাগান, পাহাড়-টিলা বেষ্টিত জেলা মৌলভীবাজার। প্রায় প্রতিটি উপজেলাতেই রয়েছে মনোমুগ্ধকর পর্যটন স্পট। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এই জেলা। প্রতিদিনই পর্যটকের পদভারে মুখর থাকে স্পটগুলো। এমনই একটি স্পট হামহাম জলপ্রপাত। কমলগঞ্জ উপজেলার গহীন অরণ্যে লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছে নয়নাভিরাম এই জলপ্রপাতটি, যা স্থানীয়দের কাছে হামহাম জলপ্রপাত নামেই পরিচিত।

প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভারত সীমান্তঘেষা গভীর বনে আবিষ্কৃত বাংলাদেশের অন্যতম জলধারার জলপ্রপাত হামহাম দেখতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সেখানে ছুঠে চলেছেন হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক। গহীন অরণ্যের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এ জলপ্রপাতটি ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের শরীর লেপটে।

নির্জন, শান্ত পাহাড়ের প্রায় দেড়শ ফুট উঁচু থেকে আছড়ে পড়া স্রোতধারার কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফলের গাছ আগলে রেখেছে পরম মমতায় সৃষ্টির এক বিস্ময়কে।
প্রায় ১৫০ ফুট বা তার অধিক ওপর থেকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পানি আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের গায়ে। সেই পানি থেকে সৃষ্ট জলকনা তৈরি করছে কুয়াশার আবরণ। চোখজুড়ানো এই দৃশ্য দেখতে পাবেন কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত ঘুরতে গেলে।

সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩৮ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি। এটির নাম ও উচ্চতা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা একে ‘হামহাম ঝর্না’ বা অনেকে ‘হাম্মাম’ ঝর্না আবার কেউ আম-আম বলে ডাকে। এটির উচ্চতা কারও মতে ১৫০-১৬০ ফুট আবার কেউ ১৭০ ফুটের কথা বলেন। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তের একেবারে কাছাকাছি অবস্থিত।

দীর্ঘ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু গহীন অরণ্যের পথ বেয়ে এই জলপ্রপাত দেখতে প্রতিদিন আগমন ঘটছে বহু পর্যটকের। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের ঢল নামে। যাওয়ার পথের দুপাশের বনের দৃশ্য যে কোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে। বন, পাহাড়, ঝিরিপথ দিয়ে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে নানা ধরনের গাছগাছালি, বিভিন্ন পশু ও পাখি।

উপজেলার সীমান্তবর্তী চাম্পারায় চা বাগান পার হয়ে আসতে হবে কলাবন পাড়া। কলাবন গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের এলাকা শুরু। এ কলাবন থেকেই বনের মধ্যেই ট্র্যাকিং করতে হবে প্রায় আড়াই-তিন ঘণ্টা। কলাবন পাড়ায়ই গাড়ি পথের সমাপ্তি। হামহাম পিপাসুদের কেন্দ্র করে স্থানীয়রা এখানে গড়ে তুলেছেন একাধিক ভাতের দোকান। তবে অন্যান্য ভাতের দোকানের নিয়মের সঙ্গে এখানের দোকানগুলোর মিল নেই। এখানে ভাত খেতে হলে দোকানিকে অগ্রিম জানিয়ে দিতে হবে। যাওয়ার পথে দোকানগুলোতে অগ্রিম অর্ডার দিলে সেই অনুপাতেই তৈরি হয় খাবার। কলাবন পাড়ায় পর্যটকদের গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা মিলবে স্থানীয় কিছু যুবক ও শিশুর। শিশুরা বাঁশের খুটি বিক্রির জন্য আর যুবকরা গাইড হতে ছুটে আসে। পাথুরে পাহাড় পথ আর ঝিরিপথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাবেন হামহাম জলপ্রপাতের কাছে। কিছু দূর এগুলেই শুনতে পাবেন হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ।

যাওয়ার পথে কথা হয় ময়মনসিংহ থেকে আসা পর্যটক অভিজিৎ সরকার ও সিয়াম মাহমুদের সঙ্গে। ভারাক্রান্ত মনে তারা বলেন, হামহামকে কাছ থেকে দেখতে অনেকবার তারিখ পরিবর্তনের পর এবার ছুটে এসেছিলাম। কিন্তু পাহাড়ি আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্তি বোধ করায় ঝিরিপথ অবধি পৌঁছার আগেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। শুধু অভিজিৎ সরকার ও সিয়াম মাহমুদই নন, অনেকেই বনের ভেতর থেকে ফিরে আসেন বাকি পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস না পাওয়ায়।

রাস্থায় যেতে যেতে কথা হয় ইউটিউবার সাইফুল ইসলাম সোহাগের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশ-বিদেশের অনেক জায়গায় ছোটবেলা থেকে ভ্রমণ করলেও হামহাম ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা অন্য কোনো ভ্রমণে পাননি। ঝর্ণার কাছে গিয়ে কথা হয় হবিগঞ্জ থেকে আসা তোফাজ্জল চৌধুরী, কামরুল ইসলাম মুখলেস, সাইফুল ইসলাম, সাইফুর রহমানদের সাথে তারা জানান, বছর খানেক আগে প্রথমবার এসে হামহামের সৌন্দর্যতার প্রেমে পড়ায় এবার বিডি ট্রাভেলিং গ্রুপের ৪৫ জন বন্ধুকে নিয়ে তারা এখানে এসেছেন।

কলাবনের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, ভোর থেকেই পর্যটকরা আসতে থাকেন। সবাই হামহাম যাওয়াতে সফল হন না। অনেকেই ফিরে আসেন কিছু রাস্তা পাড়ি দেওয়ার পর। মূলত তরুণরাই হামহাম যাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৭০ ভাগই তরুণ। দৃঢ় মনোবল থাকলে হামহাম ঝর্ণার রূপ দেখা সম্ভব।

 
Electronic Paper