ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইটের দেয়ালে নতুন স্বপ্ন ভূমিহীন দুই সাওতাল ভূমিপুত্রের

রিপন দাস, বড়লেখা (মৌলভীবাজার)
🕐 ২:৩৯ অপরাহ্ণ, মে ১১, ২০২১

ইটের দেয়ালে নতুন স্বপ্ন ভূমিহীন দুই সাওতাল ভূমিপুত্রের

দেশের অন্যতম বিলুপ্ত বন্য প্রাণী শজারু হত্যার দায়ে সাজা হয় সুবল ভূমিজ ও জগো রবিচন্দ্র সাঁওতালের। সাজা দেওয়ার পর ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে আসে মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই তাদের। অন্যের বাড়িতে করছেন জীবনযাপন। দিনমজুরির টাকা দিয়ে চলে তাদের সংসার। যেন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তারা তখনও কারাগারে। ইউএনও উদ্যোগ নেন তাদের ঘর তৈরি করে দেওয়ার। তাদের অজান্তেই। জেল থেকে বের হয়ে তারা জানতে পারে তাদের জন্য তৈরি হচ্ছে ঘর।

তাদের চোখের সামনে পাকা ঘরে উঠেছে। নতুন ঘর পেয়ে একজন বিয়েও করেছেন। নতুন ঘরে শুরু করেছেন নতুন সংসার। ভুলে গেছেন সাজার কষ্ট। ঘটনাটি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের দুই ভূমিহীন যুবক সুবল ভূমিজ ও জগো সাঁওতাল বড়লেখা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ডিমাই এলাকার বাসিন্দা।

গত বছরের (১৪ নভেম্বর) রাতে বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের বাজারিছড়ায় বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী শজারু হত্যার দায়ে ৯জনকে আটক করে বনবিভাগের বড়লেখা কার্যালয়ের লোকজন। ওই রাতে ঘটনাস্থলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শামীম আল ইমরান সুবল ভূমিজ ও জগো রবিচন্দ্র সাঁওতালের এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। অন্য ৭জনকে অর্থদণ্ড প্রদান করেন। পরে দণ্ডিতরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে বন্য প্রাণী হত্যা না করে রক্ষা করার অঙ্গীকার করেন।

সাজা দেওয়ার পরদিন ইউএনও ডিমাই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নেন তাদের (সুবল ও জগো) সম্পর্কে। জানতে পারেন এরা ভূমিহীন। এলাকা ঘুরে এসে ইউএনও নিজের ফেসবুক আইডিতে ‘‘পাপকে ঘৃনা করুন, পাপী কে নয়’’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গৃহহীনদের বরাদ্দ হওয়া ঘর থেকে সুবল ও জগো’র জন্য ঘর তৈরির উদ্যোগ নেন।

কারাগার থেকে বের হয়ে সুবল ভূমিজ ও জগো রবিচন্দ্র সাঁওতাল জীবিকার তাগিদে দিনমজুরির কাজ শুরু করে। প্রতিদিন পাহাড়ে যাবার সময় তাদের চোখে পড়ে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট দিয়ে ঘর তৈরির কাজ চলছে। তারা তখনও জানতো না ঘরগুলো কাদের জন্য তৈরি হচ্ছে। তাদের চোখের সামনেই পাকা ঘর উঠেছে। ঘরে রঙ দেওয়া হয়েছে। একসময় জানতে পারে; যে বিচারক তাদের জেল দিয়েছেন তিনিই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকা ঘর তাদের তৈরি করে দিয়েছেন। ঘর পেয়ে দারুণ খুশি তারা। নতুন ঘর পেয়েই তাদের একজন জগো রবিচন্দ্র সাঁওতাল বিয়েও করেছেন।

গত শনিবার (৯ মে) বিকেলে জগো রবিচন্দ্র সাঁওতাল ও তার স্ত্রীর জন্য নগদ অর্থ এবং উপহার নিয়ে যান বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম আল ইমরান। নবদম্পতিকে উপহারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তুলে দেন।

এ সময় বড়লেখা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. উবায়েদ উল্লাহ খান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, বড়লেখা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন, স্থানীয় ইউপি সদস্য ফখরুল ইসলাম প্রমুখ।

বড়লেখা উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গৃহহীনদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ প্রত্যেকটি ঘরে আছে দুটি কক্ষ। সঙ্গে রয়েছে রান্নাঘর, বারান্দা, সংযুক্ত শৌচাগার। এতে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। সুবল ও জগো ছাড়াও বড়লেখা সদর ইউনিয়নের ডিমাই এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আরও ৪টি পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাচ্ছে।

নতুন ঘর পাওয়া সুবল ভূমিজ বলেন, ‘আমরা জানতাম না শজারু মারলে অপরাধ। জেল হবে। বনবিভাগের লোকজন ধরে ইউএনও স্যারের কাছে আমাদের দেয়। স্যার আমরারে জেল দেন। জেল থেকে বের হয়ে দেখি আমাদের এলাকায় নতুন ঘর হচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ। পাকা ঘর বানানোর সামর্থ্য নেই। আমরা মনে করছি বড়লোক কেউ ঘর বানায়। কিছুদিন পর জানতে পারলাম যে স্যার আমরারে জেল দিছেন তিনই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর দিয়েছেন। ঘর পেয়ে খুব আনন্দ লাগছে। স্যাররে কইছি আমরা আর শজারু মারতাম নায়। রক্ষা করমু।’

ঘর পেয়ে নতুন বিয়ে করা জগো রবিচন্দ্র সাঁওতাল বলেন, ‘দিনমজুর করে খাই আমরা। পাকা ঘর বানানোর সামর্থ্য নেই। অন্যের বাড়িতে থাকতাম। শজারু মেরে জেলে যাই। জেল থেকে বের হয়ে শুনি আমরারে শেখ হাসিনার দেওয়া ঘর দিছন ম্যাজিস্ট্রেট। ইটা শুনিয়া জেলের কষ্ট ভুলি গেছি। স্যার যে আমরারে মনে করছইন এর লাগি খুশি। জীবনেও একটা মাটির ঘর বানাইতে পারতাম না। ঘর পাইয়া বিয়া করলাম। স্যার আমারে উপহার দিছইন। ঘরে তুলিয়া দিছইন।’

বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শামীম আল ইমরান বলেন, ‘তারা অজ্ঞানতাবশত বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী শজারু হত্যা করে। বনবিভাগের লোকজন তাদের আটক করে। আইন অনুযায়ী তাদের জেল দেওয়া হয়। এসময় তাদের প্রাণী হত্যা না করার জন্য বুঝানো হয়। এরপর তারা বন্য প্রাণী শিকার না করে সংরক্ষণ করবে বলে জানায়। পরদিন তাদের খোঁজ নেই। জানতে পারি তারা ভূমিহীন। নিজেদের থাকারও ঘর নেই। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের পাকা ঘর তৈরি করে দেই। ঘর পেয়ে তারা খুব খুশি। তাদের একজন নতুন ঘর পেয়ে বিয়েও করেছে। গত শনিবার নতুন দম্পতিকে নগদ অর্থ ও উপহার দিয়ে ঘর তুলে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘর পেয়ে প্রান্তিক মানুষগুলো দারুণ খুশি।’

 
Electronic Paper