ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সংস্কার অভাবে সিলেটর রেলপথ যেন মরণ ফাঁদ

সিলেট প্রতিনিধি
🕐 ৪:০০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০১৯

১৮৯১ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে বাংলার পূর্বদিকে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। মূলত আসামের চা রোপণকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে নির্মিত হয় রেললাইন। ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে রেল যোগাযোগ ছড়িয়ে পড়ে। পরে ১৯১২-১৫ সালে চালু হয় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন।

সেই ব্রিটিশ আমলের নির্মিত লাইনে ভর করেই চলছে পূর্বাঞ্চলের রেলপথ। কখনও সেভাবে কোনো সংস্কার করা হয়নি। হয়তো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এখনও এ রুটের রেললাইনের অনেক জায়গায় স্লিপারের নাট-বল্টু নেই। যে কারণে সিলেটর রেলপথ যেন মরণ ফাঁদ হয়ে উঠছে।

জরাজীর্ণ লাইনে ঘটছে ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনা। একারণে নিরাপদ রেলসেবার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মানুষের মনে। যাত্রীদের মনে তৈরি হয়েছে সংশয়।

আর এই সংশয়ের নেপথ্যে রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা ট্রেন দুর্ঘটনাগুলো। গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের বরমচাল এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪ যাত্রী নিহত ও শতাধিক আহতের ঘটনা ভুলতে বসেছিল এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু সোমবার (১১ নভেম্বর) রাতে উদয়ন এক্সপ্রেস ও তূর্ণা নিশীথার দুর্ঘটনা রেলসেবা নিয়ে মানুষের মনে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে।

সিলেটের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, ঘূর্নিঝড়েও এতো লোক মরেনি, যত মানুষ এক ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তারা জরাজীর্ণ লাইন সংস্কার, সিলেট রুটে আন্তঃনগর ট্রেনে নতুন কোচ সংযোগসহ রেলসেবার মান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে দেশের রেলপথে সিলেট রুটে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতো দুর্ঘটনা দেশের অন্য কোনো রুটে ঘটেনি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত ৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর আগে গত ১৭ সেপ্টম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে জালালাবাদ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুরে এবং তারও আগে গত ১৬ আগস্ট ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও রেলস্টেশনে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়।

গত ১৯ জুলাই সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশন রেলস্টেশনে ঢোকার সময় যাত্রীবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাত্রীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

পরদিন (২০ জুলাই) সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে একইস্থানে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর কালনী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ওইদিন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের লোকো সেকশনের এক কর্মচারী বলেছিলেন, আগের দিন দুর্ঘটনায় স্লিপারের অন্তত ২০টি ক্লিপ উঠে যায়। সেগুলো মেরামত না করায় পুনরায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে রেলের পাটাতনে ২-৩টি স্লিপারের পর একটি করে ক্লিপ লাগানো থাকে। যে কারণে ট্রেন দ্রুত চলতে গেলে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত ২৩ জুন রাত ১০টায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনে যাওয়ার আগে বরমচাল অতিক্রম করে মনছড়া রেলসেতুতে দুর্ঘটনায় ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। একটি বগি সেতুর নিচে ও দু’টি পার্শ্ববর্তী জমিতে উল্টে যায়। এতে চার জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

গত ১৬ মে বেলা ১১টার দিকে ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা সেতু পার হয়ে মল্লিকপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় ট্রেনটি। এতে করে দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

এর আগে ৫ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় সিলেট-মাইজগাঁও রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী মোগলাবাজার এলাকায় কুশিয়ায়া এক্সপ্রেস লোকাল ট্রেনটিতে ইঞ্জিন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় চালক ট্রেনটি টেনে মোগলাবাজার রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যান। ট্রেনের ইঞ্জিন গরম হয়ে হঠাৎ করে আগুণ লাগার ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।

এদিন রাত পৌ‌নে ১১টার দি‌কে মাইজগাঁও স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় শাহজালাল সারকারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রে‌নের বগি‌টি লাইনচ্যুত হওয়ায় ব্যাহত হয় যোগাযোগ ব্যবস্থা।

গত ৯ মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জে অল্পের জন্য বেঁচে যায় জয়ন্তিকা ট্রেনের যাত্রীরা। ট্রেনটি ফেঞ্চুগঞ্জ কুশিয়ারা রেলসেতুর পাশেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এদিন কুশিয়ারা রেলসেতুর দক্ষিণে রেললাইন এক ফুট জায়গা ভেঙে যায়। এটা দেখে স্থানীয় ব্যবসায়ী ছালিক মিয়া তাৎক্ষণিক মাইজগাঁও স্টেশনে জানালে তারা ফোন করে দুই পাশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন। তাৎক্ষণিক রেল যোগাযোগ বন্ধ করা না হলে ভয়ানক কিছু ঘটতে পারতো।

সর্বশেষ সোমবার (১১ নভেম্বর) রাত পৌনে ৯টায় চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন ১৬টি কোচে ৭০৩ জন যাত্রী নিয়ে সিলেট রেলস্টেশন ছেড়ে যায়। ট্রেনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পৌঁছালে ঢাকা অভিমুখী ‘তুর্ণা নিশীথা’র সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ১৬ জন যাত্রী নিহত হন, আহত হয় শতাধিক।

এছাড়া ২০০৪ সালে জোট সরকারের সময় আধুনিক অবকাঠামোয় গড়ে ওঠা রেলস্টেশনের উদ্বোধন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান। উদ্বোধনের পরই স্টেশনের ছাদে চিড় (ফাটল) ধরায় কাজের অনিয়ম নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। আর দেড়দশক পার হলেও সিলেট রেলওয়ে স্টেশনে অবকাঠামোগত উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে দেড় দশকেও সিলেট রেলস্টেশনের জীর্ণ দশা কাটছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংস্কারের বিষয়ে তারা উপর মহলে চিঠি দিয়েছেন। তা কার্যকর হতে সময় লাগছে।

 
Electronic Paper