বর্ষার শুরুতেই পাহাড়ি ঢল
হৃদয় ইসলাম, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার)
🕐 ১১:২১ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৬, ২০১৯
বর্ষার শুরুতেই ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের কারণে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় কয়েকটি গ্রামে বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এরমধ্যে দুটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুরনো ভাঙা বাঁধ মেরামত না হওয়ায় অনায়াসেই আদমপুর ইউনিয়নের ঘোড়ামারা ও নাজাতকোনা গ্রামে ঢলের পানি ঢুকে ঘরে আটকা পড়েছে অর্ধশতাধিক পরিবার। বিস্তীর্ণ ইউনিয়নের আরও অনেক পরিবার যে কোনো মুহূর্তে পনিবন্দি হওয়ার হুমকির মুখে রয়েছে।
গত শুক্রবার রাত থেকে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার প্রধান দুটি নদী ধলাই ও মনু নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ১৩৮ সেমি এবং মনু নদীর পানি বিপদসীমার ২০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তের ৪৮ কিমি দূরে ভারতের নলকাটা ব্যারাজ খুলে দেওয়ার ফলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, নাজাতকোনা ও পশ্চিম ঘোড়ামারা গ্রামে কয়েক বছর ধরেই বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভাঙা থাকার কারণে এই অবস্থা দেখা গেছে। এবারও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরনো ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ মেরামতে স্থানীয়দের অসহযোগীতাকে দায়ী করছে। স্থানীয় প্রভাবশালী একটি পরিবারের বাধা দেওয়ার কারণেই গত বছর বাঁধ মেরামত মুখ থুবড়ে পড়ে দাবি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও এলাকাবাসী।
সরেজমিন দেখা যায়, শুক্রবার দুপুর থেকে ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘোড়ামারা গ্রাম এলাকায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুপুরে নাজাতকোনা এলাকায় ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরনো বিশাল একটি ভাঙন দিয়ে পানি উপচে প্লাবিত হচ্ছে গ্রাম। তবে বিকাল পর্যন্ত ঘোড়ামারা ও নাজাতকোনা গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। দুই দিনের বৃষ্টিপাতে ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ধলাই নদী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠছে।
গ্রামের আবদুল ওয়াহিদ, নুরুজ্জামান মিয়া, তমিজ উদ্দীন, রমিজ উদ্দীন, মন্নাফ মিয়া, জমশেদ মিয়া, মর্জিনা বিবি, আবেদা বেগম, আবদুল গফুর, সমেদ মিয়া, ওয়েছ মিয়া, হেলাল উদ্দীন, সাজেদা বেগম, মাজিদা বেগমের ঘরগুলো নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। পানির তোড়ে ঘোড়ামারা গ্রামের এলজিইডির রাস্তাটি ২-৩ ফুট পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ঘোড়ামারা গ্রামে মণিপুরী থিয়েটারে পানি প্রবেশ করেছে।
কমলগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ঘোড়ামারা গ্রামের হোসেন আলীর মেয়ে কলেজছাত্রী রওশন আরা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ধলাই নদীভাঙনে আমরা গ্রামের পনেরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছি। নদীর বাঁধ মেরামত না হওয়ায় স্রোতের পানি থাকার একমাত্র ঘরটি নদী গিলে নিচে। এখন আমাদের থাকার মতো স্থায়ী জায়গা নেই। আমাদের অসহায়ত্ব দেখার মতো কেউ নেই। কোথায় যাব, কোথায় থাকব, কি খাব কেউ খবর নেয় না।
পশ্চিম ঘোড়ামারা গ্রামে নদীর গ্রাস হওয়া বাড়িঘর ঘুরে দেখা যায়, নদীর স্রোতে হোসেন আলীসহ গ্রামের পনেরোটি ঘর নদীভাঙনের কবলে পড়ে। আরও পাঁচটি রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। হোসেন আলীর পাকা ঘরের অর্ধেক অংশ নদীতে চলে গেছে। ঘরের অবশিষ্ট অংশে বাঁশের বেড়া দিয়ে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
ঘোড়ামারা গ্রামের মজিদা বেগম, নুরুজ্জামান, সাজেদা বেগম ও আবদুল গফুর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বর্ষার আগে যদি আমাদের এলাকায় নদীর বাঁধ মেরামত করা হতো তাহলে আর আমাদের এই ক্ষতি হতো না। কিছুদিন পূর্বে নদীর স্রোতে আমাদের ঘরগুলো নদীতে চলে গেছে। এখন আমাদের থাকার জায়গা নেই। আমরা এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাইনি।
ঘোড়ামারা গ্রামের বাসিন্দা মণিপুরী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা কবি ও নাট্যকার সুভাশীস সমীর ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার জ্যোতি সিন্হা বলেন, আকস্মিক বন্যায় ফের কবলিত হয়েছে আমাদের ঘোড়ামারা গ্রাম। উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে আমাদের বাড়ির উঠান ডুবে গেছে। গ্রামের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে ধলাই নদীতে গতবার যে বিরাট ভাঙন হয়েছিল, প্রলয়ঙ্করী বন্যা এসেছিল, একটি মাত্র পরিবারের বাধায় সেখানে আজও বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি, স্থানীয় প্রশাসনও ব্যর্থ। মাত্র বর্ষার মৌসুম শুরু। এবার কয়েকদফা বন্যা আসে জানি না। এই গ্রামেই মণিপুরি থিয়েটার অডিটোরিয়াম (গতবার অনেক ক্ষতি হয়েছিল ভবনটির), মণ্ডপ, প্রাইমারি স্কুলসহ আরো অনেক কিছু রয়েছে। এবারও কি রেহাই পাবে না কোনোটাই! তারা বিষয়টির অতি দ্রুত সমাধান ও নদীতে বাঁধ দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন প্রশাসনের কাছে।
আদমপুর ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দীন বলেন, আসলে এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছর কাজে এলেও কিছু মানুষের আপত্তির কারণে কাজ করা সম্ভব হয়নি।
কমলগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, সরেজমিন ঘুরে দেখবেন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছি।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, বিগত ২০১৭ সালে বাঁধ মেরামতের জন্য জন্য যে প্রকল্প নেওয়া হয় সেখানে স্থানীয়দের আপত্তির কারণে ঠিকাদার কাজ করতে পারেনি। পরে বাধ্য হয়ে ঠিকাদার চলে আসেন। বর্তমানেও যদি জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়দের সহযোগিতা পাওয়া যায় এবং ঘরগুলো সরানো হয় তাহলে কাজ করা সম্ভব হবে।