১৬ দিন ধরে অন্ধকারে ১০০টি আধিবাসি পরিবার
মো. সহিবুর রহমান, হবিগঞ্জ
🕐 ৫:৫২ অপরাহ্ণ, জুন ১১, ২০২২
বন বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিভাগের দ্বন্দ্বে হবিগঞ্জের বাহুবলে আধিবাসি সম্প্রদায়ের ১০০টি পরিবার ১৫ দিন ধরে অন্ধকারে রয়েছে। সংযোগের তিন বছর পর ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার আইন নেই’ দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ। যে কারণে ওই পরিবারগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, নিজেদের কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য বন বিভাগ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। যদিও সংযোগের তিন বছর পর কেন বেকে বসেছে বন বিভাগ সেটি স্পষ্ট নয় বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে।
হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল জোনাল কার্যালয় থেকে জানা যায়, বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়ি বন বিটের ‘মধুপুর হিল রিজার্ভ ফরেস্ট’র দূর্গম পাহাড়ি এলাকা কালিগজিয়া। সেখানে দুটি টিলার পরও ৩০০ আধিবাসি পরিবারের বাস। ২০১৮ সালের শেষের দিকে কালিগজিয়ার ১০০টি পরিবারকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল জোনাল অফিস। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। ২০২০ সালে পুটিজুড়ি বন বিট অফিসও একটি সংযোগ নেয়।
২০২১ সালের প্রথম দিকে ওই এলাকার ২ নম্বর টিলায় বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি খুঁটি বসানোর কাজ শুরু করলে বাঁধা দেয় বন বিভাগ। এক পর্যায়ে তারা হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওএন্ডএম) মো. শহীদ উল্লাহর নাম উল্লেখ করে তিনজনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ বন আদালতে মামলা করেন পুটিজুড়ি বন বিটের তৎকালিন বিট কর্মকর্তা জুয়েল রানা। মামলায় বনের প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টাকা ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়।
করোনার কারণে দীর্ঘদিন মামলার অগ্রগতি না থাকলেও চলতি বছরের ২৬ মে আসামীদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ বিভাগ ২৫ মে ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সরবরাহ বন্ধ থাকায় গত ১৫ দিন ধরে ওই এলাকার ১০০টি পরিবার অন্ধকারে রয়েছে। এতে ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায়। এছাড়া সেখানে গড়ে ওঠা তাঁত পল্লিতেও প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন না নারীরা।
কালিগজিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুনীল দেববর্মা বলেন, ‘তিন বছর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। তখন বন বিভাগ কোন বাঁধা দেয়নি। এখন বিদ্যুৎ বিভাগের লোকদের সাথে বন বিভাগের কোন একটা বিষয় নিয়ে ঝামেলা লাগায় তারা মামলা করছে। এতে আমাদের বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিয়েছ।’
গৌতম দেববর্মা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দেশের একটি পরিবারও অন্ধকারে থাকবে না। তাহলে আমরা কেন বিদ্যুৎ পাব না। আমরাতো এই এলাকায় শত শত বছর ধরে বসবাস করছি। আমরা কি এ দেশের নাগরিক না?
ওই গ্রামের এসএসসি পরিক্ষার্থী পায়েল দেববর্মা বলেন, ‘এই গ্রাম থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পরিক্ষা দেব আমরা ১২ জন। এখন হঠাৎ করে বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকভাবে লেখাপড়া করতে পারছি না। কিছুদিন পর পরিক্ষা, যদি বিদ্যুৎ না আসে তাহলে আমরা খুব বিপদে পরে যাব।’
কালিগজিয়া আধিবাসি মহিলা সমিতির সভাপতি স্বপ্না দেববর্মা বলেন, ‘বিদ্যুৎ আসার পর হারিকেনসহ রাতে আলো জ্বালাতে যে জিনিসপত্র ছিল সবগুলো পেলে দেয়া হয়েছে। এখন আমরা মোমবাতি দিয়ে চলি। মোমবাতি দিয়ে কতদিন চলা যায় বলেন। এছাড়া রাতের অন্ধকারে বন্যপ্রাণীরাও আমাদের বাড়ি-ঘরে হামলা করে।’
কালিগজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক সীমা দেববর্মা বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় শিশুরা মন দিয়ে লেখাপড়া করতে পারছেন না। এছাড়া আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা খাবার পানি। এমনিতেই আমরা পাহাড়িরা পানির সমস্যায় ভোগী। তার মধ্যে বিদ্যুৎ না থাকায় মোটর দিয়ে পানি তুলতে পারছি না। স্কুলে আসলে কোন শিক্ষার্থী পানি খেতে পারে না।’
হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বাহুবল জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওএন্ডএম) মো. শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘যখন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয় তখন বন বিভাগ বাঁধা দেয়নি। এমনকি তারা নিজেরাও একটি সংযোগ নিয়েছে। পরবর্তীতে দুই নম্বর টিলায় সংযোগ দিতে গেলে তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তাই মামলা করেছে।’ তবে স্বার্থ কি সেটা তিনি জানেন না বলেন জানান।
শহীদ উল্লাহ বলেন, ‘বন বিভাগ আমাদের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। মূলত সরকারি দপ্তরের কোন মামলায় নাম উল্লেখ করার কথা না। এতেই বুঝা যায় তারা উদ্দেশ্যে প্রণোধিতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছে।’
বন বিভাগ বলছে- প্রথম সংযোগের সময়ই বিদ্যুৎ বিভাগকে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু তারা বাধা উপেক্ষা করে সংযোগ দেয়। এরপর বারবার বলার পরও তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেনি, তাই মামলা করা হয়েছে।
মধুপুর হিল রিজার্ভ ফরেস্ট’র পুটিজুড়ি বীট কর্মকর্তা রতিন্দ্র কিশোর রায় বলেন, ‘আমার আগে কর্মকর্তা মামলাটি করেছিলেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নিয়ম নেই বলেই তিনি মামলাটি করেন।’
বাহুবল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহুয়া শারমিন ফাতেমা বলেন, ‘ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার নিয়ম নেই এটা সত্য। কিন্তু যেহেতু দেয়া হয়েছে সেহেতু তিন বছর পর লাইন বিচ্ছিন্ন করাটা ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। যদিও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সংযোগ দেয়া সম্ভব না, তবুও মানবিক বিষয় বিবেচনা করে পুণরায় সংযোগটি চালু করার চেষ্টা করব।’