ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মরুর বুকে দেশপ্রেমের গল্প

ক্রীড়া প্রতিবেদক
🕐 ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮

কে যেন লিখেছিলেন, ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, এটা জীবনের ক্রীড়া সংস্করণ। কেন লিখেছিলেন? জীবনের মতো ক্রিকেটেও ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তা আছে বলে’? হয়তো তাই! শুধু অনিশ্চয়তা নয়, জয়-পরাজয় ছাপিয়ে ক্রিকেট মহান গল্পের জন্ম দেয়।

নিজের শৌর্য আর বীরত্ব দিয়ে তাই কেউ কেউ এই খেলায় মহান হয়ে ওঠেন। এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তামিম ইকবাল এবং মুশফিকুর রহীম যেমন উঠেছিলেন।
ভাঙা কব্জি নিয়ে মাঠে নেমে মাত্র এক বল খেলেছেন তামিম। কিন্তু সেই একটি বলের মোকাবেলা করার জন্য যে বীরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে মাঠে ফিরতে হয়েছে তাতেই জিতে গেছে বাংলাদেশ। মরুর বুকে গত শনিবার ১১ জনের বাংলাদেশ জেতেনি। জিতেছে ১৬ কোটি বাঙালির দেশপ্রেম।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শনিবার টস জিতে আগে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। প্রথম ওভারেই ২ উইকেট হারিয়ে ফেলা দলটা শেষ পর্যন্ত অলআউট হওয়ার আগে স্কোরবোর্ডে যোগ করে ২৬১ রান। মুশফিকুর রহীম খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৪৪ রানের ইনিংস। জবাব দিতে নেমে টাইগার বোলারদের তোপে শুরু থেকেই দিশেহারা শ্রীলঙ্কা। ম্যাচটা কেউ দেখে না থাকলে শুধু জয়ের ব্যবধানটা হয়তো ‘একতরফা’ ম্যাচের কথা বলবে। আসলে কিন্তু ম্যাচের পরতে পরতে ছিল দেশপ্রেমের গল্প। লাল সবুজের জন্য জীবন বাজি রাখার গল্প।
ম্যাচের আগের রাতে পাঁজরের পুরনো ব্যথাটা জেগে ওঠায় যার ম্যাচ খেলাই ছিল অনিশ্চিত, সেই মুশফিকুর রহীম খেললেন ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। সেটিও দলের চরম বিপর্যয়ে ব্যাট করতে নেমে। চোট পেয়ে তামিম ইকবাল শুরুতেই মাঠ ছাড়লেন। খেলা চলাকালেই হাসপাতালে ছুটতে হলো তাকে। ফিরলেন হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে। এমনকি কমপক্ষে ছয় সপ্তাহের জন্য যে তিনি ছিটকে গেছেন, সেই খবরও অজানা থাকল না কারও।
কিন্তু সেই তামিমই দলের প্রয়োজনে মাঠে নেমে পড়লেন ব্যান্ডেজ হাতে। দশম ওভারে মুশফিকের সঙ্গে ৩২ রানের জুটি হলো তার। বাংলাদেশ পেল লড়াকু পুঁজি। খেলা তো সত্যিই কখনো কখনো খেলার চেয়ে বেশি। এক বছর পর দলে ফেরা লাসিথ মালিঙ্গা ভয় হয়ে দেখা দিয়েছিলেন প্রথমে। ইনিংসের প্রথম ওভারেই তিনি তুলে নেন লিটন দাস ও সাকিব আল হাসানকে। সুরঙ্গা লাকমালের দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন তামিম। তার লাফিয়ে ওঠা বলটা লাগে তামিমের কব্জিতে। ২ ওভার শেষে তামিমের রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়া ছাড়াই বাংলাদেশের স্কোর ২ উইকেটে ১ রান। ভয়াবহ বিপর্যয়ই তখন দেখছিল সবাই। এর মধ্যে মুশফিক ও মিথুন ক্যাচ তুলে দিলেন কয়েকবার। কিন্তু এরপর নিজেদের মানিয়ে নিয়ে দুইজনই খেললেন দারুণ ইনিংস। ১৩১ রানের জুটি তাদের। ১০ রানের মধ্যে ২ উইকেটে হারানোর পর তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি জুটি এটি। মিথুন আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি তুলে ফেরেন শুরুতে ভয় ধরানো মালিঙ্গার বলেই। ৬৮ বলে ৬৩ রান করেন তিনি ৫টি চার ও ২টি ছক্কা মেরে। মিথুন ফেরার পর আবারও পথ হারালো বাংলাদেশ। মাহমুদউল্লাহ (১), মোসাদ্দেক হোসেন (১) দুজনই ফিরে গেলেন দ্রুত। ৮ রানের মধ্যে তিন উইকেট হারিয়ে আবারও শুরুর চেহারায় তখন বাংলাদেশ। মুশফিকের সঙ্গে এরপর মেহেদী হাসান মিরাজের ৩৩ রানের জুটিটিকে কার্যকরই বলতে হবে। মাশরাফির সঙ্গে জুটিটি ২০ রানের বেশি হলো না। মিরাজ ১৫ ও মাশরাফি ১১ রান করে ফেরেন। মুশফিক সেঞ্চুরি করতে পারবেন কি না, তখন সেটি নিয়েই গুঞ্জন। রুবেল হোসেন ৮ রানের জুটি গড়তে পারলেন মুশফিকের সঙ্গে। একবার তো আম্পায়ার এলবিডব্লিউ দিতেই হাঁটতে লাগলেন। সেখান থেকে মুশফিক ফেরালেন তাকে। রিউউ নিয়ে আউট থেকেও বাঁচলেন রুবেল।
শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজের সঙ্গে জুটিতে সেঞ্চুরি ধরা দিল মুশফিকের। নবম উইকেট এই দুজনের জুটি ২৬ রানের। যেখানে মোস্তাফিজের অবদান ১ চারে ১০ রান। এরপর তামিমের ব্যাটিংয়ে নেমে যাওয়া। যে লাকমলের বলে আহত হয়েছিলেন তাকেই খেললেন একহাতে। সাহসী তামিমকে পেয়ে মুশফিকের ব্যাটও হয়ে গেল খাপখোলা তলোয়ার। শেষ পর্যন্ত থিসারা পেরেরার বলে থামলেন তিনি। আর অমর কাব্যের জন্ম দেওয়া তামিম অপরাজিতই থেকে গেলেন। শ্রীলঙ্কার পক্ষে সর্বাধিক ৪ উইকেট মালিঙ্গার। ২ উইকেটে নিয়েছেন ধনাঞ্জয়া ডি সিলভা। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন লাকমল, আপোন্সো ও থিসারা পেরেরা। মুশফিকের ওই দৃঢ়তা আর তামিমের সাহসী ভূমিকার পর বোলারদের যা করার তা তারা করলেন নিখুঁতভাবে। উপুল থারাঙ্গা নেমেই ঝড় তুলতে চাইলেন। কিন্তু ১৬ বলে ৪ চার ও ১ ছক্কায় যখন মাশরাফির বলে বোল্ট হলেন, তখন মাথা নিচু করেই ফিরতে হলো তাকে। তার আগেই শূন্য রানে জীবন মেন্ডিসকে ফিরিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। আর মাশরাফি ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে ফিরিয়ে দেন শূন্য রানে। তাতে ৩২ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে পথ হারায় শ্রীলঙ্কা। ৮ রানের ব্যবধানে কুশল পেরেরাকে ফিরিয়ে দেন মিরাজ।
পঞ্চম উইকেটে দাসুন শানাকা ও অধিয়ানক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শানাকাকে (৭) ফিরতে হয় সাকিব ও মিরাজ কম্বিনেশনে রান আউট হয়ে। আর ম্যাথুজকে ফিরিয়ে দেন রুবেল হোসেন। তাতে ৬৩ রানে ৬ উইকেট নেই শ্রীলঙ্কার। ৬ রানের ব্যবধানে থিসারা পেরেরাও (৬) মিরাজের শিকার হয়ে ফিরে গেলে শ্রীলঙ্কার পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
তবে বাংলাদেশের জয়কে খানিকটা বিলম্বিত করলেন শ্রীলঙ্কার লেজের ব্যাটসম্যানরা। সুরঙ্গা লাকমল টাইগার বোলারদের অষ্টম শিকার হওয়ার আগে করেন ২০ রান। মোস্তাফিজের দ্বিতীয় শিকার তিনি। আর দিলরুয়ান পেরেরা মোসাদ্দেকের শিকার হওয়ার আগে করেন ২৯ রান। উইকেটে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা আপোন্সোকে ফিরিয়ে লঙ্কানদের ইনিংসের ইতি টেনেছেন সাকিব। ৩১ বলে ৪ রান করেন আপোন্সো। টাইগারদের পক্ষে ২টি করে উইকেট নেন মাশরাফি, মোস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। ১টি করে উইকেট নিয়েছেন সাকিব আল হাসান, রুবেল হোসেন ও মোসাদ্দেক হোসেন। ম্যাচসেরা হন মুশফিকুর রহীম।

 
Electronic Paper