ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

রাশিয়া বিশ্বকাপ উদ্বাস্তুদের

অরুণাভ পাত্র
🕐 ১০:৩৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৮

ছয় বছর বয়সে পিতামহকে গুলি করে মেরেছিল সার্ব জঙ্গিরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল বসতভিটা। বাবা যোগ দিয়েছিলেন গেরিলা বাহিনীতে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় তখন ক্রোটদের স্বাধীনতারযুদ্ধ। রাতারাতি ঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল সাত বছরের লুকা মডরিচকে। গুলি, বোমা, গ্রেনেড বিস্ফোরণ পেরিয়ে ঠাঁই মিলেছিল এক হোটেলে। সেই হোটেলের সামনের ফুটপাথেই ফুটবল পেটানো শুরু।

পঁচিশ বছর পর সেই ফুটপাথই হয়ে গেল রাশিয়ার লুজনিয়াকি স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকে চ্যাম্পিয়ন করতে রোববার মাঠে নেমেছিলেন। সেদিনের উদ্বাস্তু, রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্সআপ দলের অধিনায়ক লুকা মডরিচ। শুধু মডরিচ নন, এই বিশ্বকাপ আসলে উদ্বাস্তু-ঘরছাড়াদের বিশ্বকাপ। সেসব ঘর ছাড়ারা, যারা কোনো রকমে মাথা গুঁজতে পারেন ইউরোপের বড় শহরগুলোর বাইরের উদ্বাস্তু কলোনিতে। এই শরণার্থী শিবিরগুলোই এখন বিশ্ব ফুটবলের সাপ্লাই লাইন। ভালো ফুটবলারের খোঁজে যেখানে উঁকি মারেন পৃথিবীর সেরা ক্লাবগুলোর ফুটবল কর্মকর্তারা। এই মুহূর্তে যে ইউরোপ এশিয়া-আফ্রিকা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের খেদাতে মরিয়া, ছুড়ে দিচ্ছে ঘৃণা আর সন্দেহ, তাদের পূর্বসূরিরাই কিন্তু এখন ইউরোপীয় ফুটবলের ভরসা।
মডেলটা প্রথম আনে ফ্রান্স। নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের ঔপনিবেশ থেকে প্রয়োজনমতো লোক তুলে আনা শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশে তখন কাজ করার লোক চাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত পূর্ব ইউরোপ, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আনা হতো শ্রমিক। তাদের ঠাঁই হতো শহরের বাইরে। ছয় ও সাতের দশকেও পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা ও আরব থেকে উদ্বাস্তুদের অবিরাম মিছিল আছড়ে পড়েছিল এই শহরতলিগুলোতে।
উপচেপড়া ভিড়, দারিদ্র্য, নিয়মিত দাঙ্গা, মাদক আর অপরাধ জগতের হাতছানি-এই ছিল নতুন আসা মানুষগুলোর রোজগার জীবন। সঙ্গে উপরি পাওনা ছিল মূলবাসীদের ঘৃণা।
এ সময়টাই ফরাসি ফুটবলের সব থেকে খারাপ সময়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪, এই চৌদ্দ বছরে একের পর এক বিশ্বকাপ, ইউরোতে যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় ফ্রান্স। এর পরই তারা তৈরি করে পৃথিবীর প্রথম আধুনিক ফুটবল একাডেমি। আর শহরের বাইরে লুকিয়ে থাকা শহরতলি থেকেই বেরিয়ে আসতে শুরু করে ফরাসি ফুটবলের সোনার প্রজন্ম।
নয়ের দশকে সেই সোনালি প্রজন্মই ফ্রান্সকে বিশ্বসেরা করে। আরব-আফ্রিকান-শ্বেতাঙ্গ এই মেলবন্ধনই ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি। প্যারিসে আসে ইউরো, বিশ্বকাপ। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলে ১২ জনই ছিলেন প্রথম অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী। তার পর থেকে এই ছকেই হাঁটছে ফরাসি ফুটবল সংস্থা। এই বিশ্বকাপেও ফ্রান্স ফুটবল দলে খাঁটি ফরাসির সংখ্যা দুই। বিভিন্ন আফ্রিকান দেশের শরণার্থী সংখ্যা ১৫ জন। পোগবা, মাতুইদি, এমপাপে, উমতিতি, কাঁতে-র সবাই আফ্রিকান। এদের হাতেই এখন ফরাসি ফুটবলের ভবিষ্যৎ।
শুধু ফ্রান্স নয়, এই মডেলে হাঁটছে এখন গোটা ইউরোপই। এ পথে হেঁটেই ইউরোপ এখন বিশ্ব ফুটবলের সর্বেসর্বা।
রাশিয়া বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপের বাইরের দল বলতে ছিল শুধু ব্রাজিল আর উরুগুয়ে। সেমিফাইনালে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়া-শুধুই ইউরোপ। আর এ চারটি দলেই অভিবাসীদের ভিড়। ইউরোপের প্রধান দশটি ফুটবল খেলিয়ে দেশের এবারের বিশ্বকাপ টিমে ৮৩ জন অভিবাসী। সারা দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে তারা নগণ্য হলেও, ফুটবল মাঠে এখন এই অভিবাসীদেরই দাপট। যে অনুপ্রবেশকারীকে ইউরোপের মানুষ এক সময় শুধু ঘৃণা বা করুণার চোখেই দেখেছে,  আজ তিনি বা তার বংশধররাই সেই দেশের মান-সম্মান-গৌরব অর্জনের লড়াকু সৈনিক, এমনকি কেউ কেউ সেনাপতিও।
কিন্তু তার বাইরে কেমন আছেন অভিবাসীরা?
এখনো তো যুদ্ধ-সন্ত্রাস-গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত এশিয়া-আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আছড়ে পড়ে উদ্বাস্তুদের মিছিল। গত তিন বছরে শুধু ইতালিতেই সমুদ্র পেরিয়ে পাড়ে এসে পৌঁছেছেন পাঁচ লাখেরও বেশি শরণার্থী। ভাঙা নৌকা, কাঠকুটো আঁকড়ে যারা পৌঁছেছেন, তারা ভাগ্যবান। সমুদ্রে কত মানুষ হারিয়ে গিয়েছেন তার সঠিক হিসাব রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছেও নেই।
লিবিয়া-সিরিয়া-নাইজেরিয়ার ঘরছাড়া শরণার্থীদের জায়গা দেওয়া দূরের কথা, তাদের আটকাতে দেশের সমুদ্রবন্দরগুলো বন্ধ করেছে ইতালি সরকার। শুধু তাই নয়, যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই ঘরছাড়াদের সমুদ্র থেকে উদ্ধারের কাজ করছিল, সেই বোটগুলোকেও এলাকা ছাড়া করে ইতালির নৌসেনা। হঠাৎ করেই কমে গিয়েছে ইতালির মাটিতে পৌঁছানো মানুষগুলোর সংখ্যা। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ইতালি। আরও বেশি মানুষ হারিয়ে যাচ্ছেন ভূমধ্যসাগরের অতলে।
শুধু ইতালি নয়, গত তিন বছরে ইউরোপের প্রায় সব দেশই সীমান্ত আরও দুর্ভেদ্য করেছে। উদ্বাস্তু শিশুদের প্রকল্প বন্ধ করেছে ইংল্যান্ড; আশ্রয় চাওয়া মানুষদের ফিরিয়েছে জার্মানি; ভদ্রভাবে থাকতে না পারলে দেশ থেকে উদ্বাস্তুদের বের করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে নেদারল্যান্ডস; উদ্বাস্তুদের জেলে ভরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাঙ্গেরি; সীমান্ত বন্ধ করেছে স্লোভেনিয়া; দেশ থেকে শরণার্থীদের বহিষ্কার করেছে পোল্যান্ড। যারা কোনো রকমে খোলা আকাশের নিচে মাথা গুঁজতে পারছেন, তাদের কপালেও জুটছে সন্ত্রাসবাদী ও দেশের সম্পত্তি ধ্বংস করার তকমা।
এই বিদ্বেষ উঁকি দেয় ফুটবল মাঠেও। ফ্রান্সকে বিশ্বসেরা করার পরও জিদানদের শুনতে হয়েছিল, তারা খেলা শুরুর আগে জোর গলায় জাতীয় সংগীত গান না। বিড়বিড় করেন। কারণ তারা অভিবাসী, আসলে ফ্রান্সকে ভালোবাসেন না। এমন মারাত্মক অভিযোগ এনেছিলেন ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী দলের নেতা লা পেন। বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের সদস্য লঁরা ব্লাও ফরাসি ফুটবল একাডেমিগুলো থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ও আরবদের দূরে সরিয়ে রাখা উচিত বলে বেফাঁস মন্তব্য করেছিলেন। বেলজিয়ামের সেরা দলের প্রধান স্ট্রাইকার হওয়া সত্ত্বেও কী কারণে তার অতীত বারবার টেনে আনা হয়, তা ভালোই বুঝতে পারেন লুকাকু।
এভাবেই ঘৃণাকে সঙ্গী করে, উদ্বাস্তু ছাপ্পা নিয়ে, বেঁচে থাকেন লাখ লাখ শরণার্থী। আলান কুর্দিদের মৃতদেহ ভেসে ওঠে সমুদ্রে। আর দেশহীন, পতাকাহীন, জার্সিহীন লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়দাতা দেশের গৌরব বাড়াতে লড়ে যান প্রতিমুহূর্তে। ফুটবলের মঞ্চে এখন সেই উদ্বাস্তুদেরই জয়গান। এই বিশ্বকাপ আক্ষরিক অর্থেই উদ্বাস্তুদের বিশ্বকাপ।

 
Electronic Paper