ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কেমন হলো রাশিয়া বিশ্বকাপ

ক্রীড়া ডেস্ক
🕐 ১০:৩৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৬, ২০১৮

ব্রিটিশ বিদেশ সচিব বরিস জনসনের মন্তব্য দিয়েই লেখাটা শুরু করা যেতে পারে। রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিককে অ্যাডল্ফ হিটলার ও তার নাৎসি ব্রিগেড যেভাবে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন শাসিত রাশিয়ায় ফুটবল বিশ্বকাপকেও সেভাবে ব্যবহার করা হবে।’

১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিককে কীভাবে ব্যবহার করেছিলেন অ্যাডল্ফ হিটলার? ইতিহাস একবার ফিরে দেখা যাক। ১৯৩১-এ অলিম্পিক কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৩৬-এর আগস্ট মাসে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে    বার্লিনে। ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছিলেন অ্যাডল্ফ হিটলার। এরপরই শুরু হয়ে যায় কমিউনিস্ট ও ইহুদি নিধন। বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। হিটলার ঠিক করেন এ সমালোচনা যে অসত্য, তা প্রমাণ করতে বার্লিন অলিম্পিককে ব্যবহার করবেন। জার্মান ফেন্সিং তারকা হেলেন মেয়ার ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও তাকে রাখা হয় জার্মান দলে। মেয়ার রৌপ্যপদক জেতেন। পোডিয়ামে উঠে তিনি যে নাৎসি স্যালুট দিতে বাধ্য হন সে ছবির ব্যাপক প্রচার করা হয়। গোয়েবলস সমস্ত জার্মান পত্র-পত্রিকাকে নির্দেশ দেন অলিম্পিকসের সময় যেন ইহুদিবিরোধী লেখালিখি বন্ধ রাখা হয়। রাস্তাঘাট থেকে সব ইহুদিবিরোধী নোটিস সরিয়ে ফেলা হয়। আদেশ জারি করা হয় জার্মানির সমকামিতাবিরোধী আইন বিদেশিদের বিরুদ্ধে যেন প্রয়োগ করা না হয়। তৈরি করা হয় বহু নতুন স্টেডিয়াম, ঝাঁ চকচকে অলিম্পিক ভিলেজ। সফররত দলগুলোর খেলোয়াড় এবং হাজারে হাজারে বিদেশির তাক লেগে যায়। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করে ‘আরও মানবিক হয়ে’ অন্য দেশের মধ্যে ‘ফিরে এসেছে’ জার্মানি।
এবার রাশিয়ার দিকে তাকান? ভ্লাদিমির পুতিন যে নির্দয় নীতি নিয়ে সব বিরোধিতার কণ্ঠরোধ করে রাশিয়া শাসন করে চলেছেন তা অনেকের মনেই সোভিয়েত জমানার আতঙ্ক ফিরিয়ে আনছে। ঠাণ্ডাযুদ্ধের হিম ছোঁয়া ফিরিয়ে এনে বিদেশের মাটিতেও চোরাগোপ্তা পদ্ধতিতে হত্যা করা হচ্ছে পুতিন শাসনতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক যে কোনো ব্যক্তিকে। এটা পুতিনের শাসন পদ্ধতির একটা দিক। অন্য আর একটা দিক হলো রুশ জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলে আর সব ভিন্নমতের স্বরকে ডুবিয়ে মারা।
এমন জটিল প্রেক্ষাপটেই এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করেছিল রাশিয়া। খেলাধুলার পরিকাঠামো; মানে মখমলের মতো সবুজ মাঠ, আলো ঝলমলে স্টেডিয়াম, চ্যানেলে চ্যানেলে মস্কো সেন্ট পিটার্সবার্গের তাক লাগানো স্থাপত্য, রাস্তায় রাস্তায় উত্তেজিত হাসি-ভরপুর ফ্যান বিপুল আন্তর্জাতিক ভিড় সুষ্ঠুভাবে সামলানোর ব্যবস্থা, সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা-সব বিবেচনায় বিশ্বকাপ আয়োজনে সম্পূর্ণ সফল রাশিয়া।
মোটের ওপর রোববার শেষ হওয়া ২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে রাশিয়ানদের সংগঠনের ত্রুটি কেউ ধরতে পারেননি। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম রাশিয়া নিয়ে যেভাবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছিল তা ভুল প্রমানিত হয়েছে। গত শনিবার বলশই থিয়েটারে এক জমকালো অনুষ্ঠানে ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপ রাশিয়াবিরোধী অনেক ভ্রান্ত ধারণা ও বাজে মিথ ভেঙে দিয়ে গেল।’ সাংগঠনিক কমিটির জেনারেল ডিরেক্টর অ্যালেক্সেই সোরোকিনের মন্তব্যটা আরও মজার, ‘বিদেশিরা এসে আমায় প্রশ্ন করছেন, আপনারা মানুষকে কী করেছেন? বিদেশের কোথাও পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীদের হাসতে দেখিনি। এ দেশে ওরা হাসছেন। অবিশ্বাস্য।’
রাশিয়া বিশ্বকাপে ট্যাক্সি ধরানো, মেট্রো স্টেশন চিনিয়ে দেওয়া, রাশিয়ান ভাষায় গুগল ট্রানস্লেট করে অন্যদের বোঝানো, এমনকি ট্রেনে হারানো জিনিস ফেরত পেতে সাহায্য করা সব ব্যাপারে পুলিশ বিদেশিদের সাহায্য করেছে। সময় নিয়ে সিকিউরিটি চেক করেছেন। তারপর হাসিমুখে বলেছেন, ‘ভালো থাকবেন।’
আর মাঠের ফুটবল। তাতেও সফল রাশিয়া বিশ্বকাপ। অসাধারণ ফুটবল খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফরাসিরা। ফুটবলের নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে বেলজিয়াম এবং ক্রোয়েশিয়া। অনেক গোল হয়েছে। ‘ভার’ এর সাহায্য নেওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ফুটবলে কিছুটা স্বচ্ছতা এসেছে। ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনোর বিশ্লেষণে, ‘আর কেউ ভিএআর নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না। তার কারণ, সবাই এটা গ্রহণ করেছে। এ ব্যবস্থা ভালো কাজ করেছে এবং করছে। এর ফলাফল খুব ইতিবাচক। এখনো পর্যন্ত ৬২ ম্যাচে ৪৪০ বারেরও বেশি সিদ্ধান্ত চেক করা হয়েছে, ১৯ বার রিভিউ করা হয়েছে। ১৬ বার সিদ্ধান্ত পাল্টানো হয়েছে। এটাই উন্নতি। এটাই ভালো। ভিএআর ফুটবলকে আরও নিষ্কলঙ্ক করছে। আগে ৯৫ শতাংশ সিদ্ধান্ত সঠিক হতো। এখন ৯৯.৩২ শতাংশ সঠিক হচ্ছে। ভিএআরের সৌজন্যে ফুটবলে অফসাইড গোলের ইতি।’
সব মিলিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপ কেমন হয়েছে তা ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ানি ইনফান্তিনোর মুখেই শোনা যাক, ‘আমরা চেয়েছিলাম, এ বিশ্বকাপকে সবার সেরা করে তুলতে। আর এখন বলতে পারি, এটাই সেরা বিশ্বকাপ হয়েছে।’ আয়োজনে রাশিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করে ফিফা প্রেসিডেন্টের মন্তব্য, ‘এ বিশ্বকাপ রাশিয়াকে সত্যিকারের ফুটবলের দেশে বদলে দিয়েছে। ফুটবল এখন রাশিয়ার ডিএনএ-এর অংশ। এমনকি রাশিয়া সম্পর্কে সারা বিশ্বের ধারণাকেও পাল্টে দিয়েছে এ বিশ্বকাপ। এ এক মাসে প্রায় ১০ লাখ লোক রাশিয়ায় এসেছেন। সবাই এ দেশটাকে দুর্দান্ত দেশ হিসেবে আবিষ্কার করেছেন, যে দেশ তাদের সবাইকে স্বাগত জানিয়েছে। আমাদের উচিত রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানানো। দেশের সরকার, স্থানীয় অর্গানাইজিং কমিটি ও রাশিয়ার ফুটবল সংস্থাকে। আর অবশ্যই বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবকদের, যারা এ বিশ্বকাপের হাসি এবং হৃদয় হয়ে আছে। এরা সবাই কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে বিশ্বকাপটিকে সফল করে তুলেছে।’
কিন্তু এ সফলতা পুতিনের রাশিয়া কত দিন ধরে রাখতে পারে তাই দেখার।

 
Electronic Paper