ভাগ্য বাঁচাল টাইগারদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৩৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০১৯
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। বলা যায় মাত্র ১০ মিনিটের ব্যবধানে টাইগাররা ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেলেন।
গতকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় (নিউজিল্যান্ডের) দুপুর দেড়টার দিকে জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের আল নূর মসজিদে ভয়াবহ এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত। নিহতদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি বলে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো এক প্রেস রিলিজে জানানো হয়েছে। ঘটনার পর তৃতীয় টেস্ট বাতিল করা হয়েছে। ক্রিকেটাররা আজ শনিবার দেশে ফিরছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্রাইস্টচার্চের সংবাদ সম্মেলনটা শেষ করে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের জুমার নামাজ আদায় করতে যাওয়ার কথা ছিল ঠিক দেড়টায়। আল নুর মসজিদটা ছিল খুব কাছেই। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনটা দীর্ঘায়িত হয়েছিল, তাই শেষ হলো দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে। হয়তো এই ১০ মিনিট সময়ের কারণেই রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়জুড়ে থাকা টাইগার বাহিনী।
গুলিবিদ্ধ নারীর সতর্কবার্তায় মসজিদে ঢোকেননি টাইগাররা।
সংবাদ সম্মেলন শেষ করেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিকাংশ সদস্য জুমা ধরতে বাসে উঠেছিলেন। টিম টাইগারদের সদস্যরা তখন মসজিদের সামনে পৌঁছেও গিয়েছিল। মুশফিকরা মসজিদে প্রবেশ করবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে মসজিদের ভেতর থেকে মধ্য বয়সের এক নারী রক্তাক্ত অবস্থায় টলোমলো পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। তামিমরা তখনো বুঝে উঠতে পারেননি, আসলে কী ঘটছে ভেতরে। এরপরই ভেসে আসে সতর্কবাণী। একজন চিৎকার করে বলে ওঠেন, মসজিদের ভেতর গুলি চলছে।
অবস্থা দেখে তামিম, মুশফিক, তাইজুল, মিরাজরা দ্রুত হেঁটে এসে বাসে উঠে পড়েন। এ সময় পুলিশ খবর পেয়ে ওই রাস্তা বন্ধ করে দেয়। ফলে বেশ কিছুক্ষণ বাসেই বসে থাকতে হয় তামিম, মুশফিকদের। তবে গুলির শব্দ ও আতঙ্কে তারা অনেকটা সময় বাসের ভেতর মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। এ সময় তারা দেখতে পান, মসজিদের সামনে অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। অনেকে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসছেন মসজিদ থেকে, যা দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েন ক্রিকেটাররা। কারণ তখন বাসে কোনো নিরাপত্তাকর্মী দূরে থাক, স্থানীয় লিয়াজোঁ অফিসারও ছিলেন না।
রাস্তায় তখন অনেক পুলিশ। সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলেছে পুলিশের গাড়ি। অনেকক্ষণ বাসে বসে থাকার পর ক্রিকেটাররা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস থেকে নেমে মাঠের দিকে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন। সবার চোখেমুখে তখন আতঙ্ক। কারণ দূরত্বটা একেবারে কম নয়। সেটি কমাতে রাস্তা ছেড়ে সবাই নেমে পড়েন হ্যাগলি পার্কে। পার্কের মধ্য দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে সবাই মাঠে ফেরেন। মাঠে ফিরে সবাই ড্রেসিংরুমে ঢুকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। হাঁটতে হাঁটতে ক্রিকেটাররা বলছিলেন, তৃতীয় টেস্টের আগের দিন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সংবাদ সম্মেলন একটু দেরিতে শেষ না হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
হ্যাগলি ওভালের ড্রেসিংরুমে ঘণ্টা দুয়েক অবরুদ্ধ থাকার পর বাংলাদেশ দলকে বিশেষ এসকর্টে করে নভোটেল হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অবরুদ্ধ করে রাখা হয় পুরো ক্রাইস্টচার্চ শহরকে। বাংলাদেশ দল হ্যাগলি ওভালে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের একাধিক জায়গায় সন্ত্রাসী হামলার খবর আসতে থাকে। বাড়তে থাকে মৃতের সংখ্যাও।
দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল শুক্রবার সকালে লিটন দাস ও নাঈম হাসান ছাড়া দলের সবাই ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলে ওভাল মাঠে অনুশীলন করেন। এরপর মসজিদের উদ্দেশে ওই গাড়িতে ওঠেন।
চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে কেঁদে ফেলেন দলের অন্যতম সদস্য মুশফিকুর রহিম। মাঠে ফিরেও আতঙ্ক কাটছিল না তার।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মুখপাত্র জালাল ইউনুস জানিয়েছেন, দলের বেশির ভাগ সদস্য মসজিদে যাওয়ার জন্য বাসে ছিলেন। মসজিদে ঢোকার মুহূর্তে হামলার ঘটনাটি ঘটে। আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছেন।
নিরাপত্তা নিয়ে কঠোর সমালোচনা
এদিকে ক্রাইস্টচার্চের এমন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। গতকাল দুপুরে গুলশানে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আমাদের দেশে কোনো দল যখন খেলতে আসে, তখন ওরা যে ধরনের নিরাপত্তার কথা বলে, সে ধরনের নিরাপত্তাই দিতে হয়। আমরা এখন পর্যন্ত এমন কিছু (নিরাপত্তা) পাইনি। সত্যি বলতে আমরা এটা নিয়ে জোরাজুরিও করি না। অন্য দেশগুলোও দেখেছি এটা নিয়ে কিছু বলে না। নিউজিল্যান্ডে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, ওদের ধারণাই নেই। ঘটনার পর ঘটনাস্থলে পুলিশ যেতে যে সময় লেগেছে, এটাই তো অবাক করার মতো! আমার মনে হয় না আমাদের দেশে বা আশপাশের কোনো দেশে এমন কিছু হলে পুলিশ আসতে এত সময় লাগত। ওরা হয়তো অপ্রস্তুত ছিল। এখন হয়তো এই ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে।
পাপন বলেন, ক্রাইস্টচার্চের এ ঘটনা প্রমাণ করল, এ ধরনের ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কাজ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও হতে পারে। হতে পারে নিউজিল্যান্ডের মতো অতি উন্নত দেশেও। এই ঘটনার পর বাংলাদেশ দলের নিরাপত্তা নিয়ে তাই নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বিসিবি। এখন থেকে প্রতিটি বিদেশ সফরে বাংলাদেশ দলের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন তারা। আজকের ঘটনার পর এটা নিশ্চিত, এখন থেকে যে দেশেই আমাদের দল খেলতে যাক না কেন, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এটা যারা দিতে পারবে তাদের ওখানে আমরা খেলতে যেতে পারব। এ ছাড়া খেলতে যাওয়া সম্ভব না। এ ঘটনার পর বাতিল হয়ে গেছে ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট। খেলোয়াড়রা মানসিকভাবে বড় ধাক্কা খেয়েছেন। এরই মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা হয়েছে বিসিবি সভাপতির। পাপনকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ দলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, আজ শনিবার সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের দুপুর ১২টার (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা) ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন মাহমুদউল্লাহ-তামিমরা।
তামিম-মুশফিকদের ভীতিকর অভিজ্ঞতা
ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার সেই বিভীষিকাময় ঘটনা বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় এবং তাদের সঙ্গে থাকা সফরসঙ্গীরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সৃষ্টির্কতার ইচ্ছায় তারা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন।
ঘটনার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের অন্যতম সদস্য তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমসহ অনেকেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইটারে টুইট করেছেন। সেখানে তামিম উল্লেখ করেন, বন্দুকধারীদের গুলি থেকে বেঁচে গেছে গোটা দল। ভীতিকর অভিজ্ঞতা, আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন। আর মুশফিকুর রহিমের টুইটে উল্লেখ করেন, আলহামদুলিল্লাহ, ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে গুলি থেকে আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন...আমরা ভীষণ ভাগ্যবান...আর কখনো এমন কিছু দেখতে চাই না। আমাদের জন্য দোয়া করুন।’
বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স ও স্ট্র্যাটেজিক বিশ্লেষক শ্রীনিবাস টুইটে উল্লেখ করেন, বন্দুকধারীদের গুলি থেকে বেঁচে গিয়েছি! সবাই ভীষণ ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ দলের ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়েন নিউজিল্যান্ডের সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার পর একজনের (দলের খেলোয়াড়) সঙ্গে কথা বলেছি। সে কিছু না দেখলেও গুলির শব্দ শুনেছে। কোচিং স্টাফ হোটেলে অবস্থান করছে। গুলির শব্দ শুনেই খেলোয়াড়রা দৌড়ে ফিরে আসে।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড জানিয়েছে, বাংলাদেশের দলের সঙ্গে ‘সার্বক্ষণিক যোগাযোগ’ রাখা হচ্ছে। এক টুইটে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ক্রাইস্টচার্চে ভয়াবহ ঘটনায় আক্রান্তদের প্রতি আমরা হৃদয় নিংড়ানো সমবেদনা জানাচ্ছি। দুই দেশের বোর্ডের যুগ্ম সিদ্ধান্তে হ্যাগলি ওভাল টেস্ট বাতিল করা হয়েছে। দুই দল এখন নিরাপদে।
টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ পাইলটও ছিলেন তামিম-মুশফিকদের সঙ্গে। ওই ঘটনার বর্ণনায় দিয়েছেন তিনি। অক্ষত অবস্থায় টিম হোটেলে ফেরার পর পাইলট বলেন, আপনারা অনেকেই হয়ত দেখেছেন। যা আসলে আমরা কেউ আশা করি না। আমরা খুব লাকি। বাসে অনেকজন ছিলাম। প্রায় ১৭ জন। যারা নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। দু-তিনজন হয়তো হোটেলে ছিল। আমরা মসজিদের খুব কাছে ছিলাম, মাত্র ৫০ গজ দূরে। খুবই লাকি আমরা। যদি তিন চার মিনিট আগে আসতাম, হয়তো বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেত। সেখান থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসা কঠিনই ছিল। প্রায় আট দশ মিনিট বাসে ছিলাম আমরা। মাথা নিচু করে ছিলাম। এই ভয়ে যে ফায়ার হতে পারে। টেররিস্ট যদি বাসে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে? আমরা পেছনের সাইড দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে, বলতে গেলে অনেকটা দৌড়ে ড্রেসিংরুমে চলে যাই। সেখানে আলোচনা হয় কীভাবে আমরা এ জায়াগা থেকে বেরুবো। নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে আমাদের একসঙ্গে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে। তাদের তো কোনো দোষ নেই। তারা যে কালচারে অভ্যস্ত সেভাবেই চেষ্টা করেছে। ‘বাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল। কারণ, পরবর্তীতে আমরা ভিডিওতে দেখি যে, বাইরে এসে রাস্তায় লোকজনকে গুলি করেছে। বাংলাদেশের সবাই খুব উদ্বিগ্ন ছিল আমাদের নিয়ে। পুরো টিম আমাদের হোটেলে আছে। সবাই সুস্থ আছে। যে ম্যাচটা ছিল সেটা ক্যানসেল করা হয়েছে। তারা অফিসিয়ালি আমাদের ফোন করে জানিয়েছে সেটা। খুব শিগগিরই হয়তো অফিসিয়ালি মেইল পাঠাবে। ’
বোর্ড প্রেসিডেন্ট পাপন ভাইসহ বোর্ডের অন্য সদস্যরা সারাক্ষণ দলের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আমাদের দেখভাল করার জন্য, সাহস দেওয়ার জন্য বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই।’
এদিকে ঘটনার পর সাকিব আল হাসান (আঙুলের চোটের কারণে নিউজিল্যান্ড সফরে যাননি) টুইটারে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
টুইটারে তিনি লিখেছেন, সতীর্থদের বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তাকে, ‘ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। শুধু এটাই বলতে পারি, মহান আল্লাহপাকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমার ভাই ও সতীর্থদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন আজকে। আলহামদুলিল্লাহ।
এ দিকে ক্রাইস্টচার্চের হামলা নিয়ে সরব হয়েছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন। টুইট করে হামলাকারীর প্রতি ঘৃণা ও হতাহতের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছেন শহীদ আফ্রিদি, বিরাট কোহলি, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, শোয়েব আখতার, ইমরান খান, হর্শা ভোগলে, জিমি নিশাম, মিচেল ম্যাকক্লেনাঘানসহ আরও অনেকে।