ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আল মাহমুদকে শ্রদ্ধাঞ্জলি

শহীদ ইকবাল
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৯

বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রখর প্রভাবিত, ভাটিবাংলার লোকায়ত প্রাণস্পন্দনের কবি আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)। ‘তিতাস-ব্রহ্মপুত্রপারের জনজীবনকে উপলক্ষ করে সম্মোহনী লোকভাষা’ তার কাব্যে স্থিতি পায়। তার কবিতার বিষয় : লোকজ জীবনানুষঙ্গ, গ্রামীণ সংস্কার-মূল্যবোধ, মুসলিম ঐতিহ্য-পুরাণ। অসম্ভব আসঞ্জনমথিত লোক লোকান্তর (১৩৭০)-এর কবিতাগুলো লেখা হয় ১৩৬১ থেকে ১৩৭০ সালের মধ্যে। এরপর কালের কলস (১৩৭৩) ১৩৭০ থেকে ১৩৭৩ সালে। এ দুটি কাব্যের জন্য কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। এরপরে মুক্তিযুদ্ধ, এবং বাংলাদেশের জন্ম।

স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে রচিত সোনালী কাবিন (১৯৭৩), যেটি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত রচিত। সোনালী কাবিন তার সনেটগুচ্ছ। আল মাহমুদের এ তিনটি কাব্যেই বাংলাদেশের বাংলা কবিতায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সৃষ্টির গোড়া থেকে কবির দিব্যচেতনার শুলুকসন্ধানের প্রচেষ্টায়-তার এগুনোর পথ, অনুকরণের পর্যায়, পাঠকনন্দিত হওয়ার ক্ষেত্র- অনুভাব্য ও অনুসরণীয় ক্ষেত্র। এবং অবশ্যই তা পরীক্ষণীয় ব্যাপারও।

আল মাহমুদ একটা দিব্যচেতনা নিয়ে ‘নদী’, ‘মেঘ’, ‘নারী’ রচনা করে চলেন। গ্রহণ করেন তার ‘বন্দনা’র জগৎ। একইরূপে ‘ঝড়’, ‘অরণ্য’, ‘বৃষ্টি’, ‘রাত্রি’, ‘নৌকো’, ‘রক্ত’-তে আরোপ করেন যৌনতা; তখন জীবনজয়ী রূপটি হয় চিহ্নিত, পরিবেশনায় আসে ভিন্নতা। কবিতা যাবতীয় বিষয়কে স্পর্শ করে। কবি স্বীকৃতিতে থাকে ‘কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল,/ যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর নিম্ননাভিমূল’। নিত্যদিনের সময়সূত্রকে এভাবে কবি অর্পণ করেন অনিবার্য ও স্বাতন্ত্র্যের প্ররোচনায়। এ ক্ষেত্রে কিছু আত্মমগ্নতা বা আত্মলীন অনুভবও স্মরণীয়তা পেতে পারে। ‘তিতাস’ আল মাহমুদের নিজের নদী, কিন্তু স্বমতপ্রচারে নয়, রসসৃষ্টিতে তিনি অদ্বিতীয় উপহারে বয়ান করেন এরূপে-
এ আমার শৈশবের নদী এই জলের প্রহার
সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে
যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে
গতির প্রবাহ হানে।
নদী আর নারীর ব্যাখ্যায়নে অভিন্ন এ আখ্যান। আর সেখানে ‘শবরী তিতাস’, ‘যৌবনের দেশ’ কী তাৎপর্যে মহিমান্বিত! ওই ‘pastoral exploration’। শুধু ‘নদী’ নয় ‘বৃক্ষ’, ‘পাখি’ অর্জন করে মরমি রূপ। বোধকরি অবচেতনার স্তরটি ক্রমশ তাকে পয়ারবৃত্তে বেঁধে ফেলে। টোটেমরূপে এরূপটি তৈরি হলেও, প্রাচীনত্বের পটভূমিটির স্পর্শ ও আশ্রয়, লৌকিক মরীচিকামোহ, পাঠ্যরূপে অঙ্কিত হয়। মিথরঞ্জিত তুলনা অনেকান্ত, যেন রূপাতীত সংগতি, তবে এক্কেবারে অপরূপ ও বাস্তবপন্থীও।

২.
আল মাহমুদ কালের কলস কাব্যে ‘কলস’-কে প্রত্নপ্রতিমায়, পুরাণরূপে প্রতিষ্ঠা দেন, পুরা বৃত্তটিতে আলো-অন্ধকার, জন্ম-মৃত্যুর পরিচর্যায় বিরাট ভূমিপুত্ররূপে জেগে ওঠেন। এখানে কবির ইঙ্গিতটি এতই গভীর এবং নৃ-সংশ্লিষ্ট যে, সেখানে শুধু জাগরণ নয়, সন্দেহ-বিশ্বাস-সংস্কার এক বীক্ষা লাভ করে। সেখানে ঐতিহ্যিক প্রবাহ, অভিজ্ঞতায় লালিত হলেও সার্বজনীন মুরতির স্বতঃপ্রবৃত্ত আকাক্সক্ষাটি কায়েমে আনেন। উপমা, প্রতীক, রূপক প্রত্যেকটি সম্ভ্রমের নিখুঁত নিঃশ্বাস যেন অবধারিত- এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?
আল মাহমুদ সোনালী কাবিনে অগ্রসর, আবেগ-ঘনীভূত, চেতনায় স্বচ্ছ ও নিরঙ্কুশ। সদ্য স্বাধীন দেশে তার কাব্যবিষয় ওই আবহাওয়া-জলবায়ুর পরিক্রমণে। সেখানেও সনেটে ফিরে আসে শৌর্য-বীর্যগাথা, পুরনো ইতিহাস, আবহমান আবেগসংখ্যার হিসেব। মৃত্তিকা-নারী-ভ্রূণাঙ্কুর, আর কুয়াশা-আলো-অন্ধকার, স্নেহ-মায়া-প্রেম-ভালোবাসা এ কাব্যে তীক্ষ্মতর। তবে ‘সোনালী’ যৌবন-কামার্ত বা জৈবিকতার আঁধার হয়ে আসে। লোকসংস্কৃতি-লোকসংস্কার, শারীরী-সংসর্গ হয়ে ওঠে অভিন্ন দ্যোতনার সারথী। আল মাহমুদ সুন্দর নামে, চমৎকার কবিভাষ্যে আন্তর্ভৌম ও যৌক্তিক রূপটি সনেটের সীমায় অনুরুদ্ধ করেন। যেমন-
হাত বেয়ে উঠে এসো হে পানোখী, পাটিতে আমার
এবার গোটাও ফণা কালো লেখা লিখো না হৃদয়ে;
‘পানোখী’ সুন্দর শব্দপ্রতিমা। লোকায়ত আমেজে এ অসাম্প্রদায়িক লৌকিক রূপটি, সার্বজনীনরূপে অভিষিক্ত। ‘নীল’, ‘দংশন’, ‘সাপ’ এরূপে জৈবিক প্রেরণার পাশাপাশি আমাদের লৌকিক অস্তিত্বকেও তুলে ধরে। ‘কার্পাশের ফল’, ‘গুঞ্জার মালা’, আশৈশবের স্মৃতি, পরিচর্যা কখনো বৈশ্বিক হয়ে ধরা পড়ে। টোটেম-ট্যাবু বিস্তৃত হয় অস্তিত্বকে আকর করে। সামষ্টিক সুরটি বুঝি তিনিই শুনতে পান, আর এ ধারায় চর্যাযুগ, মুকুন্দরামের কাল সবই যেন পরীক্ষিত। কবি সনেটে এ প্রত্যয়সমূহ কী অমায়িক করে তোলেন, সেটা ফর্ম-পরীক্ষা করলে কিংবা ভাষার বুননটি বিবেচনায় আনলে ধরা পড়ে। কাব্যের একটি পঙ্ক্তি নিলে গোটা সমাজ-নৃতত্ত্বের অতীত বেরিয়ে পড়ে। পুনরায় বর্তমান যেন নবায়ন হয়, বংশপারম্পরিক বিপদ-বরাভয় কিংবা সংগ্রাম আর কৃষি-অর্থনীতিকে নিয়ে তা কাব্যটিকে নতুনত্ব বিলাসী করে তোলে। কবির সনেটে এটি তুমুলমাত্রায় উত্তীর্ণ।

সোনালী কাবিনে এ ছাড়াও পয়ারে বা মুক্তক প্রবর্তনার অনেককিছু কায়েম হয়েছে। কিন্তু অনেক কবিতায় জৈবিকচেতনার পুনরাবৃত্তি আছে, সেটি ডিটেলে গেলে আর ওই পর্যায়ে থাকে না। শরীর-মন-দেহ সবকিছু মিলে অর্কেস্ট্রা রচিত হতে থাকে। কিন্তু লাল-সবুজ-নীল এমত বর্ণিল প্রভাটি ‘চোখ’, ‘উল্টানো চোখ’, ‘চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়’, ‘আমার চোখের তলদেশে’ এগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ‘চোখ’ মিথে পৌঁছাতে হবে এবং যথাযথ কার্যকারণটি জানতে হবে। তখনই তা আধুনিক দৃষ্টিচেতনায় ‘টোটেম’তুল্য হয়ে উঠতে পারে। আমাদের চলমান জীবনপথের প্রতিবেশটি তখন অজ্ঞাতবাসে থাকে না। কবির সবচেয়ে আকর্ষণীয়, কবিতাধারায় অনুকরণ বা আনুকূল্যে নয় এমন উপাদানে যেমন তিনি পেয়েছেন উপকরণ, তেমনি আঙ্গিকেও নিয়েছেন স্বকীয়তায় মানিয়ে। বিশেষত, অবচেতন স্তরটিতে কবি পৌঁছেছেন আধুনিক প্রকৃত ও বাস্তবানুগ সিদ্ধিতে।

আল মাহমুদের কবিতায় এ রীতিটি বেশিদিন বহাল থাকেনি। সেটাও কি তবে এক বাস্তবতার চাপ? এমন বড় কবিরূপে যিনি শিগগিরই স্বতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান একটি একক কবিভাষার নির্মাণগুণে, সেখানে তিনি কীভাবে ‘রমণীর প্রেম আর লাবণীসৌরভ’-কে দ্বিতীয় করে তুললেন? অদ্বিতীয়, অখণ্ডে তো তাকে চায়-ই সবাই। তবে ‘খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি’র স্বপ্নটিকেও আমরা যেমন অস্বীকার করতে চাই না, তেমনি পূর্বেরটিকেও না। আঙ্গিককে ভেঙে ছত্রখান করে কী লাভ! লোকায়ত পথিকৃৎ, যে স্বপ্নজাগর প্রহরের কবি, তাকে আরও বানাতে বলতে চাই ‘কলসের সোনালী’ প্রতিকৃতি, বহুভাবে ও রকমে। এরূপ ধারাবাহিকতায় তার অন্য কাব্য মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫), আরব্য রজনীর রাজহাঁস (১৯৮৭), প্রহরান্তের পাশফেরা (১৯৮৮), এক চক্ষু হরিণ (১৯৮৯), মিথ্যাবাদী রাখাল (১৯৯৩), আমি, দূরগামী (১৯৯৪), হৃদয়পুর (১৯৯৫), দোয়েল ও দয়িতা (১৯৯৭), দ্বিতীয় ভাঙন (২০০০), নদীর ভিতরে নদী (২০০১), প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা (২০০৬), তোমার রক্তে তোমার গন্ধে (২০১০), সনেট সমগ্র (২০১৩) এবং এমন আরও অনেক কাব্য ও কবিতা। তবে গল্প বা উপন্যাসে পানকৌড়ির রক্ত (১৯৭৫) বা উপমহাদেশ (১৯৯৩) কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সামগ্রিক শিল্পীসত্তার অভিবাদনে আল মাহমুদ কালোত্তরের পথিকৃৎ। তিনি চিরায়ুষ্মান হোন।

শহীদ ইকবাল : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper