ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দূর হচ্ছে নারীর প্রতিবন্ধকতা

জাফর আহমদ
🕐 ৩:০১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৫, ২০২১

দূর হচ্ছে নারীর প্রতিবন্ধকতা

সামাজিক অসচেতনতা, কুসংস্কার ও ভুল ধারণার কারণে নারীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। ভগ্ন স্বাস্থ্য কমিয়ে দেয় তাদের কর্মক্ষমতা। আর এর মাধ্যম অর্থনৈতিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এর বিপরীতে আধুনিক ও উন্নত ধারণা সেই ক্ষতির পরিবর্তে উৎপাদন ও আয়বর্ধক কাজ করতে পারে তা দেখিয়ে দিচ্ছে রাজধানীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়ক তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ গ্রুপ। এই ইয়ুথ গ্রুপের প্রশিক্ষণ ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে নারী মৈত্রী।

 

ইয়ুথ গ্রুপ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রথম পাঁচজনের গ্রুপকে প্রশিক্ষণ দেয় নারী মৈত্রী। এরপর এই গ্রুপ ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫০ জন সদস্যে পরিণত হয়। তারা সবাই শিক্ষার্থী। এবং এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি। এই গ্রুপ রাজধানী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫, ৫১নং ওয়ার্ড এবং ঢাকা উত্তরের ৯নং ওয়ার্ডের কম আয়ের মানুষের বসবাস এলাকাগুলোতে নিয়মিত যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতা বিষয়ে কাজ করছে।

এর ফলে পাঁচ হাজার পরিবারের কমপক্ষে দুই হাজার শিক্ষার্থী সচেতন হয়েছে। তারা পিরিয়ডকে অচ্যুৎ ট্যাবু বিষয় মনে করছে না। পিরিয়ডের সময়ে খাওয়া কমিয়ে দেওয়া, স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকা ও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার মত ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকছে। পিরিয়ড কালিন প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা শারীরিক দুর্বলতা, হীনমন্যতার মত সামাজিক ব্যধি থেকে রক্ষা পাচ্ছে এবং লেখাপড়া ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে।

ইয়ুথ টিমের সদস্য আমেনা আক্তার বৃষ্টি জানান, পিরিয়ডের সময়ে পরিবার থেকে মাছ মাংস ডিম, দুধ ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার খেতে দেওয়া হতো না। স্কুলে যেতে দেওয়া হতো না বা নিজেই যেত না। এগুলো সাধারণত এ সব ওয়ার্ডের নিম্নআয়ের পরিবারগুলোতে বেশি হতো। এখন সেটা নেই বললেই চললে।

ইয়ুথ টিম থেকে প্রশিক্ষণ-সহায়তা নিচ্ছে এমন একজন শিক্ষার্থী আশা খাতুন এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আগে পিরিয়ড হলে লজ্জায় পড়তাম- অন্যে জানলে কে কি বলবে, প্যাড কোথায় পাবো, কোথায় পরিবর্তন করবো। এই লজ্জায় স্কুলেই যেতাম না। এবং তিন থেকে পাঁচ দিন বাসায় বসে থাকতাম। এটা লজ্জার কোন বিষয় নয়, এটা প্রাকৃতিক নিয়ম।’ এ সব ওয়ার্ডের অন্যশ্রমজীবী নারীরাও কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়িতে অবস্থান করতো। এমন কুসংস্কারের কারণে লেখাপড়া বা অন্য উপার্জনমুখী কাজ বন্ধ থাকত। এতে আর্থিক ক্ষতি হতো। পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতনতা মূলক কর্মকাণ্ডের ফলে পিরিয়ডকে আর অস্বাভাবিক ও লজ্জাকর কোন শারীরিক বিষয় মনে করছে না। অন্য সব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মতই মনে করছে। স্কুলে যাচ্ছে এবং স্বাভাবিক সব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার সকলের জানার অধিকার রয়েছে, এ বিষয়ে স্কুলের প্রায় ২০০০ ছাত্র-ছাত্রী জানতে পেরেছে। তাদের মাধ্যমে তার পরিবারের লোকজনও জানতে পারছে। এতে বয়ঃসন্ধিকালিন বিষয় যেমন, মাসিক হওয়া ও এ সময়ে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন, বাল্য বিবাহ, যৌন রোগ, যৌন অধিকার এবং প্রজনন অধিকারগুলো সম্পর্কে তারা জানতে পেরেছে এবং তা মেনে চলে। এর মাধ্যমে অভিভাবক মহলও সচেতন হয়েছে। ফলে কিশোর কিশোরীরা বয়োঃসন্ধিকালিন সুস্থ্য পরিবেশ পাচ্ছে। স্কুলগুলোতে এ সম্পর্কে কর্ণার তৈরি হয়েছে।

প্রশিক্ষন পরবর্তী ১০টি স্কুলে তিন হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মৈত্রীর মাধ্যমে মাসিক চলাকালীন মিনস্ট্রুয়াল হাইজিন উপকরণগুলো সরবরাহ করা হয়। এর ফলে স্কুলে উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যেখানে সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় উপরকরনের অভাবে শিক্ষার্থীরা স্কুলেই যেত না। ইয়ুথ গ্রুপের সচেতনতা গ্রুপের কার্যক্রমের ফলে স্কুল কর্তৃপক্ষও এগিয়ে এসেছে। তারা একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপাশি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে নিয়মিত সেশন নিচ্ছে।

আজকে যারা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী তারাই আগামী দিনের গৃহিণী, কর্মী। তিনি আগামী দিনের একজন মা। সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে অন্ধকারে রেখে কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য চলমান টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অন্যতম উদ্দেশ্য (ধারা ৩,৭) হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, তথ্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষায় অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি জাতীয় কর্মকৌশল এবং কর্মসূচিসমূহ অঙ্গিভূত করা। ধারা ৫ ও ৬ -এ প্রজনন স্বাস্থ্য অভিগম্যতার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবা অত্যাবশ্যক।

কার্যপদ্ধতি : ঢাকার ওয়ার্ডের ১০ স্কুল এবং কলেজে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০০০ শিক্ষর্থীকে সচেতন করা হয়েছে যার ফলে তারা এখন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজেরা দায়িত্ব পালন করতে পারছে। এদের মাধ্যমে অন্যরা জানছে।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ে বুকলেট বিতরণ, পথনাটক প্রদর্শন করা, স্বাস্থ্য সচেনতামূলক মেলা, চা-দোকান বৈঠক করা এবং গণমাধ্যমে প্রচারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। যেখানে পরিবারের নারী সদস্য ছাড়াও পুরুষ সদস্যরা উপস্থিত থাকে। তারা কোন না কোন পরিবারের সন্তান, ভাই, স্বামী, বাবা বা দাদা-নানা। নারীর পিরিয়ডসহ স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে তারাই পরিবারে গিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করছে। তারা বয়:সন্ধি কালে সন্তান ভাই-বোনদের এ ব্যপারে সহায়তা করছে।

ইয়ুথ টিমের কার্যক্রম থেকে প্রাপ্ত সুফল নিয়ে স্থানীয় মহিলা কমিশনার স্থানীয়ভাবে কাজে লাগাচ্ছে। ৪৫, ৪৬ এবং ৪৭ ওয়ার্ডের মহিলা কাউন্সিলর শেখ সাথী আক্তার বলেন, স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের সচেতন করতে ইয়ুথ টিম যে কার্যক্রম করছে এটা খুবই ফলপ্রসূ হচ্ছে। এতে নিজেরা যেমন নিরাপদ থাকছে, তাদের থেকে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আমি বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছি। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আমি সবসময় সক্রিয় থাকব এবং যে কোনো নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমি বদ্ধপরিকর।

নারীর সচেতনতামূলক এ ধরনের কার্যক্রমের ফলে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে কার্যক্রমটি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে সামাজিক ও কুসংস্কারবশত: নারীর শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তারই অংশ হিসাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সারাদেশে মাধ্যমিক স্তরের সকল বিদ্যালয়ে এডোলেসেন্ট কর্নার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এবং ইতোমধ্যে ৩৫০ টি জেলায় কাজ শুরু হয়েছে।

 
Electronic Paper