ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে কাঞ্চনের মনোরঞ্জন পোদ্দার বাড়ি
মাহবুব আলম প্রিয়, রূপগঞ্জ
🕐 ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২১
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মৃতিধন্য শিল্পনগরী খ্যাত রূপগঞ্জের আনাচে কানাচে রয়েছে প্রাচীন জনপদের নানা স্থাপনা। এসবের কিছু প্রত্নতত্ত্বের তালিকায় স্থান পেলেও বহু স্থাপনাই কালের বিবর্তে ধসে গেছে। ফলে অনেকাংশে মুছে গেছে অতীতের সব স্মৃতি।
সরকারি কিংবা ব্যক্তিগতভাবে সেইসব স্মৃতি রক্ষায় ছিল না চোখে পড়ার মতো কোনো উদ্যোগ। মুছে যাওয়ার তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে কাঞ্চনের মনোরঞ্জন পোদ্দারের বাড়ি। দুই শত বছরের পুরনো ভবন পোদ্দারদের বসতঘরটি ধসে পড়লেই যেন শেষ হবে সেই ইতিহাস!
জানা যায়, শীতলক্ষ্যার কোলঘেঁষা বালু নদীর পূর্বপাড়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলা এক সময় ছিল নারায়ণগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ঢাকা জেলার একটি অঞ্চল। নবাবী আমল থেকে এ অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের বিকাশ হলেও ব্রিটিশ শাসনামল থেকে রূপ নেয় শিল্পনগর হিসেবে। ফলে শীতলক্ষ্যা পাড়ে গড়ে ওঠে বৃহত্তম পাটকল, জামদানি তাঁত শিল্প।
এর আগে ঐতিহাসিক মসলিন কাপড় তৈরির ইতিহাস শুরু হয় এখান থেকেই। তাই রূপগঞ্জের জমিদার খ্যাত মুড়াপাড়ার জমিদার বাবু রাম রতন ব্যানার্জি, জগদিস চন্দ্র ব্যানার্জিদের মদদপুষ্ট নায়েব, পোদ্দারদের ছিল দাপুটে দিনাতিপাত। পোদ্দারদের তৈরি করা স্থাপনার অন্যতম ছিল কাঞ্চনের কেন্দুয়ার মনোরঞ্জন পোদ্দার, হরিপদ পোদ্দার, শিরা পোদ্দার হরিকান্ত পোদ্দারদের বাড়ি। সময়ের ব্যবধানে তাদের নানা স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেলেও আজো শোভা পাচ্ছে শেষ স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মনোরঞ্জন পোদ্দারের বাড়ি। তবে ওই বাড়িটিতে বসবাস করতেন তাদের বংশধর পীযূষ কান্তি পোদ্দার।
লোনা ইট, কালো পাথরের টেরাকোটা ধূসর স্মৃতি এখনও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শত শত বছরের অনাদর আর অবহেলার চিহ্ন গায়ে মেখে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্বংসাবশেষ অট্টালিকা। এখানে আবাসিক ভবন ছাড়াও উপাসনালয়, গোসলখানা হিসেবে সাঁন বাঁধানো পুকুর, পান্থশালা, দরবার কক্ষ এমনকি বাইজি কক্ষ ছিল বলে জানা গেছে।
বাড়িটি ১৯৯৪ সালে বিক্রি করে দেন মনোরঞ্জন পোদ্দার ও পীযূষ পোদ্দার। পরে তাদের পরিবারের লোকজন কিছু নারায়ণগঞ্জ জেলা শহরে কেউ কলকাতায় আবার কেউ চলে যান কানাডায়। সেই সময়ে এই বাড়ির সাড়ে ৮ বিঘা জমি ক্রয় সূত্রে মালিক হয় আড়াইহাজার উপজেলার শামীম মিয়া নামের এক শিল্পপতি। বর্তমানে ঢাকা বাইপাস সড়কের পাশে থাকা এ বাড়িটির কিছু অংশ সড়ক উন্নয়নের জন্য একোয়ার করা হয়েছে। বাকি অংশে থাকা ধ্বংসাবশেষ ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে।
বাড়িটির দেখভালে আছেন শামীম মিয়ার নিয়োগপ্রাপ্ত মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হাছান মিয়া। তিনি জানান, পোদ্দার বাড়ি ঘিরে রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। পোদ্দাররা তাদের উঠানে দুর্গামণ্ডপ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীসহ বড় বড় পূজার অনুষ্ঠান করতেন। এতে যোগ দিত ভারতের পুরোহিতগং। কথা হয় মনোরঞ্জন পোদ্দারের সবশেষ বংশধর বিভা রানী পোদ্দারের সঙ্গে।
তিনি জানান, আমার পূর্বপুরুষরা চলে যাওয়ার আগেই আমি মুসলিম হয়েছি। তবে বাড়িটি ঘিরে অনেক স্মৃতি রয়েছে। আমাদের বাপ দাদারা তাদের জমির বেশিরভাগই দান করে গেছেন। স্থানীয় মন্দির, বিদ্যালয়সহ নানা সামাজিক কাজে।
কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মজিবুর রহমান বলেন, পোদ্দারগং ছিলেন এ অঞ্চলের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। ফলে তাদের প্রাচীন আমলের বসতঘরসহ তাদের ব্যবহৃত স্থাপনার নিদর্শন কিছুটা রয়ে গেছে। তবে ব্যক্তিগত সম্পদ হওয়ায় মালিকানা বদল হয়েছে। তাই তাদের অস্তিত্বও বিলীন হতে চলেছে। তবু সেই সময়ের স্মৃতি রক্ষায় উদ্যোগ নেয়া অতীব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো পক্ষই তা করেননি। আমরা বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে পেরে ওঠতে পারিনি।