লাশের সাথে এক রাত
ইমতিয়াজ বুলবুল
🕐 ৩:০৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৩
আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করছি। হাঁটুতে সমস্যা ছিল, ডাক্তার পরামর্শ দিল অপারেশন করার জন্য। পরীক্ষার পরের সে নির্ভেজাল সময়টি পরিবার বেছে নিল। পেরেশার একটু বেশি থাকার কারণে ডাক্তার আমকে সম্পূর্ণ অচেতন না করে শুধু কোমরের নিচ পর্যন্ত অবশ করে নিল। অবশ করে নিলেও আমি যেন সব টের পাচ্ছিলাম। হাটুর কাটা অংশ জবাই করা খাশির গলার মত দেখাচ্ছিল।
সে সময়টায় মোবাইলের অতটা ব্যবস্থা ছিল না। মানুষের সাথে যোগাযোগও অতটা সুযোগ ছিল না। বরিশালে শেরে- ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। একমাসের বেশি সময় হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলাম। ভাই বোন সংখ্যায় কম আর আত্মীয় স্বজনও। তাই অধিকাংশ দিনই একা থাকতে হয়েছে, দিন রাত সারা সময়ই একা। কিছু পড়াশোনা বা লেখার মধ্যেই সময় পার হয়ে যেত। আর এর আগে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং অনেক দিন থাকতে হয়েছে। তাই হাসপাতালে থাকতে আমার খুব বেশি মন খারাপ হয়নি। আয়া নার্স অনেকেই ভালো জানতেন ও ভালোবাসতেন। কেন ভালোবাসতেন বা জানতেন তা জানা নেই। যাই হোক আসল কথায় আসি।
লোকটির বাড়ি ছিল পটুয়াখালী, কালাইয়া বা হাতিয়া থানা। জামাই বাড়ি বেড়াতে গেছে। কালাইয়া ও হাতিয়া দুই জাগাতেই মহিষ পালন হয়। পঞ্চাশোর্ধ বয়স, শক্ত বলিষ্ঠ উঁচু পুষ্ট মানুষ। শক্তিশালী একটা মহিষ যেমন তেজি ও কালো সে ও গায়ের রংটাও তাই। মনে কিছু নিবেন না জীবনের অভিজ্ঞতা তাই বলছি। মাগরিবের সালাত আদায় করার জন্য মসজিদে যাচ্ছিলো, একটা মটর সাইকেল এসে আঘাত করে। মাথায় আঘাত পায়, ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়। শরীরের কোথাও একফোঁটা রক্ত বা কোন আঘাত নাই।
পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল থেকে রেফার করে বরিশাল পাঠায়। দুই জন লোক নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করায়। ওয়ার্ডে আমার বিছানার পাশে নিচে শোয়ায়। তখনও ঘুমে ছিলাম, হঠাৎ সজাগ হয়ে যাই। রাত তখন সাড়ে সাতটা আটটা বাজে। সাথে ডাক্তারও চলে আসে। ডাক্তার ইমারজেন্সি চেক-আপ করছে আর মাথা নাড়াচ্ছে। সাথের লোক বলল ঢাকা নিয়ে যাবে কি না। ডাক্তার অপেক্ষা করতে বলল। কিছু সময়ের মধ্যে তার শ্বাস বেড়ে যায়। অক্সিজেন নিয়ে আসে আরো বিভিন্ন কিছু। বিভিন্নভাবে তার শ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বাটিতে পানি চাইলো। সাথে যারা এসেছে খালি, বাটি পাবে কোথায়? হাসপাতালে সে অবস্থা নেই। আমি টিফিন ক্যারিয়ারের একটা বাটি খুলে দেই। আর সব কিছু দেখতে থাকি। মনে মনে ভাবি দাদার মৃত্যু ও আরো একটি মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে চেয়েছিলাম, পারি নাই। এ মৃত্যুটা একেবারে চোখের সামনে হবে, দেখব মৃত্যু রূপ।
হঠাৎই কি যেন মনে করে একটু অন্য কাত হই, এক মিনিটেরও কম সময়। আবার মনে পরে না সময় নাই, সাথে সাথে ঘুরে ফিরি। আহ্ যা মনে করছি তা-ই হল, লোকটা মারা গেছে। বাটি পানি বিছানার পাশ এত কিছু দিয়ে, একবারে মুখের উপর থেকেও কিছু হল না। আমি মনে মনে চাইলাম-ই চাইলাম, হল না। ভাবলাম, আল্লাহ অবশ্যই হয়তো চাননি।
মারা যাওয়ার পর পরই সাথের লোক দুজনকে আর দেখা গেল না। ভাবলাম হয়ত লাশ নামানোর জন্য তারা ব্যস্ত আছে। ওয়ার্ডে তেমন চিল্লাচিল্লি নেই। সরকারি হাসপাতাল ওয়ার্ড ভরা রোগী তবু যেন সুনশান নিরবতা। রাত দশটার দিকে বিছানায় বসে ভাত খাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি আমার পাশে লাশ হয়ে একটা মানুষ ঘুমিয়ে আছে। আমার খাওয়া যদি সে দেখে দেখুক। রাত সাড়ে দশটার দিকে শুনতে পাই লোক দুজন ছিল পথের, তারা পুলিশি ঝামেলা এড়াতে নিরবে চলে গেছে। সবাই যেন ঘুমিয়ে পরেছে, কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু মাথার উপর ফ্যান ঘোরার কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছে। লাশ আর আমি, পাশাপাশি কেউ নেই। পাশের সিট খালি ডান পাশে পথ, মাঝখানে অনেকটা খালি। হিসাব মতে কেবল আমরা দুজন পাশাপাশি। কাউকে কোন কিছু বলার নেই, বলে কোন লাভ নেই। কারণ কেউ গুরুত্ব দেওয়ার নেই। একা বিছানার উপর বসা মনে মনে ভাবছি পাশের সিটের মানুষকে বলি রাতে যদি ভয় পাই আমার দিকে একটু খেয়াল রাখতে। তা আর বলা হয়নি। কারণ তারা ততক্ষণে প্রায় ঘুম। কেউ এসে আমায় কিছু বলে নাই বা কিছু জিজ্ঞেস করে নাই। মনে ভাবছি রাতে যদি ভয় পাই পাব। যদি তীব্র চিৎকারে ওয়ার্ডের সমস্ত নিরবতা ভেঙে যায় যাক। আমার কিছু করার নেই, আমার কোন দোষও নেই। আবার মনকে শক্ত করি না কোন ভয় পাব না, আল্লাহ আছেন আমার সাথে। মনে মনে সাহস সঞ্চার করি, হাসপাতালে এত মানুষের মধ্যে কোন অশরীরী আত্মার উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই। ডোম ঘর না হলেও আমার পাশে ডোম ঘরের মত নীরবতা।
ঘুম আসে না, শরীর গরম গরম লাগছে। তবু কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ি। হাসপাতাল থেকে আমার রিলিজ হওয়ার কথা আরো আগে। যেদিন রিলিজ দিবে ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে দেখে ইনফেকশন হয়েছে। সব সেলাইগুলো কাঁচা হয়ে গেছে। নতুন করে আবার সেলাই করতে হয়। ব্যথা দ্রুত সারার জন্য ডাক্তার ব্যথার ঔষধের সাথে ঘুমের ঔষধ দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে আবার ঘুম ভেঙে যায়। শরীর গরম হয়ে উঠে, এপাশ ওপাশ করে ভয় কাটিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। রাত তিনটা চারটার দিকে নিজেকে ভারী মনে হল। এমনি চোখ খুলে যায়। কোন মানুষের জেগে থাকার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল না। ভয়ংকর নীরবতা, লাইট সব বন্ধ, ঝাপসা আলোয় স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না। মনে হল দুই জন মানুষ অন্ধকারে বসা লাশের পাশে।
আমার হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। হ্যাংলা পাতলা মানুষটি আমি যেন মৃত্যু ব্যক্তিটির মত ফুলে ফেপে যাচ্ছি। কিছুতেই আর ডান কাত হচ্ছিনা, হতে পারছি না। কিন্তু মনে মনে ভাবতেছি যদি ওপাশ না ফিরি তাহলে ভয় আরো বাড়তে থাকবে এবং আমার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকবে। সমস্ত শরীর ভয়ে আতংকে কাটা দিচ্ছে বার বার। তবু ডান পাশ ফিরতে হবে না হয় সেলাইগুলি ছিড়ে যেতে পারে। আমি দোয়া দুরুদ পড়ে মনকে শক্ত করি। পাশ ফিরতে গিয়ে পারছি না, মন যায় শরীর যায় না। ভাবলাম এভাবে সম্ভব নয়, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। লাফ দেওয়ার মত একসাথে ঘুরে যাই। তাকিয়ে দেখি কিছুই না, ভাবলাম অথচ কি অবস্থা হচ্ছিল। মনে একটা হাসি দিয়ে বলি লাশ আমারও কিছু করার নাই আপনারও কিছু করার নেই। তবে আমাকে দেখে রাইখেন। এই বলে তার দিকে ফিরেই শুয়ে থাকি।
আর মনে মনে ভাবি হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে দেখবোও না। তাই হয়েছে, ফজরের নামাজের পরপরই তাকে নিয়ে যায়। এতবড় একটা মানুষ খাটিয়ায় উঠিয়ে নিয়ে গেছে অথচ কিছুই টের পাইনি। যেন সারারাত আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি নীরব পায়ে নিজেই হেটে গেছে। মনে মনে ভাবি আর আল্লাহর কাছে বলি এরকম হল কেন। সেলাই ইনফেকশন হল, মৃত ব্যক্তির সঙ্গ হল। হয়ত কিছু ভালো আছে এর মাঝে যা আমি জানিনা মহান আল্লাহ জানেন।
কিছু কষ্ট আনন্দের মত জেগে থাকে। অনেক কষ্ট মাটির মত লেপে থাকে বুকে। আজও বাবা-মায়ের কাছে এ ঘটনার প্রকাশ করি নাই, তাদের কষ্ট বাড়াতে। এমনকি কোন আপনজনকেও তেমন করে কিছু বলি নাই। সকল আত্মা সকল প্রাণ ভালো থাকুক।