ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মজিবর রহমান : শিল্পায়নের বাতিঘর

দেবাশীষ দত্ত
🕐 ৩:১৫ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০১৮

যে জাতি যত বেশি উন্নত, সে জাতির আত্মকথা ততবেশি সমৃদ্ধ। দৃঢ়চেতা স্বজাত শক্তির মানুষের কাব্যগুলো আরও বেশি আকর্ষণীয়, গতিময়ও বটে। যারা নশ্বর পৃথিবীতে মহাকালের যাত্রায় জমকালো কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তারাই তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সময়ের প্রয়োজনে যিনি গ্রামের মেঠোপথ থেকে উঠে এসেছেন বিশ্ববাজারে।

যিনি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অধিপতি, বিআরবি কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রাণপুরুষ মো. মজিবর রহমান। যার মেধা-মনন, সততা ও কর্ম দক্ষতা একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ীর প্রতিকৃতি। প্রতিনিয়ত নানা সম্মান ও গৌরব তাকে আলিঙ্গন করেছে কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ উঞ্চ অভ্যর্থনায়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য আত্মত্যাগের অবদানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে যাদের অক্লান্ত শ্রম দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের অভিযাত্রায় এগিয়ে নিয়েছেন, সেই অমরগাঁথা ইতিহাসের অন্যতম কারিগর মো. মজিবর রহমান।

কুষ্টিয়া শহরসংলগ্ন হাটশ হরিপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা কিয়াম উদ্দীন মালিথা ও মাতা ছিরাতুন্নেছা। সংসারে চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ সন্তান। পারিবারিক ঐতিহ্যে বাবা কিয়াম উদ্দীন মালিথা একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। সংগত কারণেই ছোটবেলা থেকেই বড় ভাই বজলার রহমানের হাত ধরে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করেন একজন সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে। ব্যবসার প্রতি তার দুনির্বার আকর্ষণের কারণে ঝুঁকে পড়েন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি। যে কারণে বেশি দূর এগুতে পারেননি লেখাপড়ায়। একটানা পরিশ্রম ও ব্যবসায়ী সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মার্জিত ব্যবহারে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি ব্যবসায়ী পরিচিতি বনে যান। পারিবারিক ব্যবসায়ী ঐতিহ্য ও নৈতিক আদর্শের কারণেই এ সময় ওই অঞ্চলে একজন সফল হার্ডওয়্যার, সাপ্লাই ও ঠিকাদারি ব্যবসায়ী হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

ইতোমধ্যে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এই অস্থিতিশীলতায় ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। সমাগত ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর তহবিল গঠনের জন্য আহ্বান করেন দেশের মানুষের কাছে। এ সময় ২৪ বছরের তরুণ ব্যবসায়ী মো. মজিবর রহমান বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর তহবিলে অর্থ দেন।

অতঃপর অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। কুষ্টিয়াতেও পাক-হানাদারের তাণ্ডব থেকে বাদ যায়নি। সে সময়ের তরুণ ব্যবসায়ী মো. মজিবর রহমান বঙ্গবন্ধুর তহবিলে অর্থ দেন। এ খবর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস খ্যাত শত্রুপক্ষের মাধ্যমে এ দেশীয় দোসররা পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্পে। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারের যৌথ হামলায় এ ব্যবসায়ীর পৈতৃক নিবাসসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগ করে ছাইভষ্ম করে দেওয়া হয়। মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে তিনি দেশমাতৃকার আন্দোলনে শরিক হতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। আর দেশ বলতে একটি ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছু নয়। সবই গড়তে হবে নতুন করে, সাজাতে হবে নতুনভাবে। তারুণ্যদীপ্ত মজিবর রহমান দেশ পুনর্গঠনে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে আবারও সুদৃঢ় করতে মনোনিবেশ করলেন। তখনো দেশজুড়ে পাকসেনার বর্বরতার দগদগে ঘা অর্থনীতির রুগ্নকায় শরীরে বিদ্যমান। জলে-স্থলে, সড়ক-রেলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র হাহাকার অবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা নাজুক। একজন সম্ভাবনাময়ী যুবক হিসেবে মজিবর রহমানের চোখজুড়ে তখন সেসব বিভৎস মানবতার আর্তনাদ। আর এ বিষয়গুলো তাকে দারুণভাবে বিমর্ষ করে তোলে।

অতঃপর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিপর্যস্ত দেশ এবং জাতিকে পুনর্গঠনের জন্য সবার প্রতি আবারও মহান নেতার উদাত্ত আহ্বান। জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্পকারখানা বিনির্মাণ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পমনস্কদের এগিয়ে আসার জন্যও তিনি আহ্বান জানালেন। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়স্পর্শী ভাষণ তরুণ ব্যবসায়ী মো. মজিবর রহমানকে উজ্জীবিত করে তোলে কর্মসংস্থানের পরিকল্পনায়। তিনি চিন্তাপ্রসূত ধারণা থেকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে একটি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কুষ্টিয়া বিসিক নগরীতে ১৯৭৮ সালের ২৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বিআরবি কেবল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। যে স্বপ্নের শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় কালরাত্রিতে, যে স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে, সে স্বপ্নের অঙ্কুরোদগম হলো ১৯৭৮ সালের ২৩ অক্টোবর।

প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও সে সময় বিদ্যুৎ না থাকা, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে অর্থ সংকট ইত্যাদি নানান প্রতিকূলতার কারণে ১৯৮০ সালের ২৩ জানুয়ারি বাণিজ্যিকভাবে পণ্য উপাদনের মাধ্যমে নতুন দিনের প্রত্যাশায় হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করে।

১৯৯৪ সালের দিকে দেশে ব্যাপকভাবে বিদ্যুতায়নের জোয়ার আসে এবং এরই মধ্যে বিআরবি কেবলস উন্নত পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে সর্বোচ্চ গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করায় বাজারে এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। শিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশে তার একাগ্রতা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং কঠোর শ্রমের মধ্য দিয়ে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য প্রস্তুতসহ আধুনিক বিশ্বের সর্বাধুনিক মেশিনারিজ আমদানি করে উৎপাদন বিভাগকে করেন মজবুত ও সুসংহত। ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় ক্রমান্বয়েই বাড়তে থাকে এর চাহিদা। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে ও নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন তালিকায় অন্তর্ভুক্তিতে প্রয়োজন হয় আবারও কারখানা সম্প্রসারণের ও উন্নত মেশিনারি আমদানির। আর তাই ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে অত্যাধুনিক মেশিনারি আমদানিপূর্বক কারখানাটি সম্প্রসারণ করা হয়।

২০০০ সালে জাপান, জার্মানি, ইতালি, ভারত, বেলজিয়াম, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি সংবলিত মেশিনারি আমদানিপূর্বক পুনরায় এর সম্প্রসারণ করা হয়। সেই সঙ্গে বিআরবি কেবলসের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক মান বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ থেকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়। উন্নত বিশ্বের এসব আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে ও দক্ষ দেশি-বিদেশি কৌশলী দ্বারা উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে চালানো হয় পরীক্ষা, ফলে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান হয় সুনিশ্চিত। বৈদ্যুতিক কেবলসের সব ধরনের টেস্ট সম্পাদনে এরকম সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি বাংলাদেশে শুধু বিআরবি কেবলসেরই রয়েছে।

যেহেতু এটি একটি ভারী শিল্পকারখানা, এখানকার কর্মকাণ্ড নারীদের কর্ম উপযোগী ছিল না। তবে বর্তমানে কিছু হালকা কাজের ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় এখানে কিছু নারী শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র তৈরির ফলে ইতোমধ্যে নারী শ্রমিকরা যথেষ্ট অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখে চলেছে।

মো. মজিবর রহমান কর্মক্ষেত্রে একজন মানুষকে যেমন দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে প্রস্তুত তেমনি ব্যক্তিজীবনেও তাকে রাসুল (সা.) আদর্শে গড়ে তুলতেও বদ্ধপরিকর। তাই তিনি প্রতিবছর কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মধ্য থেকে ধর্মপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের তার ব্যক্তিগত অর্থায়নে পবিত্র হজব্রত পালন করিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত সর্বমোট ৭৫৯ জন পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন।

বিআরবি কেবলসের পরিভ্রমণ ৪১ বছরে পদার্পণ। এটি গন্তব্য নয়, অগ্রসরমান চলার পথের একটি অংশবিশেষ তথা একটি মাইলফলক। যে পথচলা শুরু হয়েছিল একটি অর্থনীতি স্বনির্ভর দেশ ও জাতি গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে। স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে এর স্বপ্নদ্রষ্টা আজও লড়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে। আজ সেই বিআরবি অন্যতম বিশ্বে বাংলাদেশে শীর্ষে স্লোগানকে সামনে রেখে ৪০ বছরে বিশ্বজুড়ে।

মো. মজিবর রহমান তিনি অনেকের প্রিয় সৃহৃদ, বন্ধু ও ভ্রাতা। যার জীবন, ভেতর-বাইরে তপ্ত রোদে ঝলসে যাওয়া পোড় খাওয়া নিখাদ-দাগহীন মানুষ। মেধা, সত্যনিষ্ঠা, অসাধারণ যোগ্যতা, কর্মকুশল সর্বোপরি কাজপাগল মানুষ হিসেবেই তার পরিচয়। সময়ের দাবি নিয়ে কাক্সিক্ষত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে একজন লড়াকু সৈনিক, আবার কখনো তিনি সেনাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এ জন্যই প্রতিনিয়ত নান ফুলে ও ফলে তার গোলা ভরে গেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই দৌড়ে তিনি বিজয়ীই হয়েছেন বারবার।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper