হার না মানা উন্নয়ন
নিত্যানন্দ হালদার
🕐 ১:১৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০১৮
পদ্মা বহুমুখী সেতু এখন আর স্বপ্ন নয় বাস্তব। এ স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেশের সর্ববৃহৎ সুপার স্ট্যাকচার। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন এবং ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খা। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মতো এক নতুন ইতিহাস। কিন্তু এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে শুরু থেকেই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা হয় সরকার তথা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এ মিথ্যা অভিযোগ মাথায় নিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তিনি পদত্যাগ করেন। একই অভিযোগের কারণে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয় দাতা সংস্থা। নিন্দুকরা চেয়েছিল পদ্মা সেতু যেন পদ্মার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। তারা চেয়েছিল বর্তমান সরকার যেন জনগণের কাছে খেলার পুতুলে পরিণত হয়। চেয়েছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষু্ণ্ন করতে। অথচ, এখন দৃশ্যমান এ পদ্মা সেতুকে ঘিরে নির্মিত হচ্ছে প্রথম ইনফরমেশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, হাইটেক পার্ক, বেনারসি পল্লী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দাদাভাই উপশহর, অলিম্পিক ভিলেজ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চারলেন বিশিষ্ট বৃহৎ এক্সপ্রেস ওয়ে, রেলপথ, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়কসহ অর্থনৈতিক জোন।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, ‘মানুষ ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখে তা স্বপ্ন নয়, যে স্বপ্ন মানুষকে ঘুমতে দেয় না সেটাই স্বপ্ন।’ তাই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ঘোষণা দিলেন নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে। এ পদ্মা সেতুর স্বপ্নই তাকে ঘুমতে দিচ্ছিল না। শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ঘোষণায় দেশবাসী প্রাণ ফিরে পায় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ আশার আলো দেখতে পেলেও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে নিন্দুকরা। তিনি যাতে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করতে না পারেন সে জন্য কেউ কেউ বিদেশের মাটিতে বসে আবারও ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হয়। তখনো কোন কোন মহল এ নিয়ে উপহাস শুরু করে। এটা সম্ভব হবে না, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, কোনো দিনও এ দেশের মানুষ পদ্মা সেতুর মুখ দেখবে না এমন আরও অনেক বিদ্রুপ করেছেন নিন্দুকরা। কিন্তু থেমে থাকেনি পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম। ২০১৯ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে নির্মাণ কার্যক্রম। এ স্বপ্ন পদ্মার বুকে প্রথম দৃশ্যমান হয় গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যখন প্রথম স্প্যান পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার নাওডোবা পয়েন্টে পিলারের ওপর বসানো হয়; তখনো নিন্দুকরা থেমে থাকেনি। বিদ্রুপের সঙ্গে বলেছেন জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখে দুই পাড়ের মানুষ যখন আনন্দে উৎফুল্ল; তখনো পদ্মা সেতু নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত থাকে। তবুও পিছ পা হননি ১৬ কোটি মানুষের আলোকবর্তিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বৃহৎ এ কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে থাকে স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। স্বস্তি ফিরে পায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭ কোটি মানুষ।
এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পিলারের ওপর বসানো হয় দ্বিতীয় স্প্যান। দ্বিতীয় স্প্যান বসানোর ৪২ দিনের মাথায় ১১ মার্চ বসানো হয় তৃতীয় স্প্যান। এ তৃতীয় স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর কাজ আরও একধাপ এগিয়ে গেল। পদ্মার বুকে দৃশ্যমান হলো ৪৫০ মিটার অর্থাৎ প্রায় আধা কিলোমিটার সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার ৭ কোটি মানুষের প্রাণের সেতু নয়।
এখন দেশের ১৬ কোটি মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এ পদ্মা সেতুকে ঘিরে। বৃহৎ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার দাবি উঠেছে পদ্মা সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মাদারীপুর-শরীয়তপুরে। যাতে দেশের অর্থনৈতিক ভিত আরও শক্তিশালী হয়। শিগগিরই বসানো হবে চতুর্থ স্প্যান এমনটাই প্রত্যাশা পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। এ অবস্থায় নিন্দুকরা আর কি বলবেন; তা শোনার অপেক্ষায় দেশবাসী।
এখন শোনা যাচ্ছে পদ্মা সেতু নিয়ে কোনো দুর্নীতি হয়নি। এমন কি কানাডার আদালতও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। দাতা সংস্থা অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তাহলে বিদেশের মাটিতে বসে কে বা কারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন?
অবশেষে চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং আলোচিত-সমালোচিত পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুর জেলার জাজিরার নাওডোবা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে। এরপর চলতি বছর ২৮ জানুয়ারি রোববার সকালে মূল পিলারে ওপর দ্বিতীর স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুর ৩০০ মিটার দৃশ্যমান হয়। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক স্প্যান মূল পিলারের ওপর বসানোর জন্য জোরেশোরে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্টরা।
প্রথম ও দ্বিতীয় স্প্যান বসানোর পর এবার তৃতীয় স্প্যান বসানো হলো পদ্মা সেতুতে। ১১ মার্চ রোববার সকাল সাড়ে ৯টার সময় জাজিরার নাওডোবা প্রান্তের ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের ওপর এ সুপার স্ট্রাকচার বসানো হয়। তৃতীয় স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৪৫০ মিটার অর্থাৎ প্রায় আধা কিলোমিটার দৃশ্যমান হলো পদ্মা সেতু।
গত শনিবার ১৫০ মিটার দৈর্ঘের স্প্যানটি ৩ হাজার ৬০০ টন ওজনের একটি ভাসমান ক্রেন দিয়ে মুন্সীগঞ্জের লোহজং কুমারভোগ ইয়ার্ড থেকে জাজিরার নাওডোবা প্রান্তে স্প্যানটি আনা হয়। জনসধারণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে জাজিরার মঙ্গলমাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট হতে লৌহজং এর শিমুলিয়া ঘাটের সঙ্গে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। গত শনিবার বেলা ১২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। বিকল্প একটি চ্যানেল ব্যবহার করে ট্রলার ও স্পিডেবোট চলাচল করে। রোববার ভোরে ৪০ ও ৪১ নম্বর খুঁটির কাছাকাছি ক্রেনটি নেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ক্রেন দিয়ে ৩৯ ও ৪০ নম্বর খুঁটির ওপরে স্প্যানটি তোলার কাজ শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্প্যানটি পুরোপুরি খুঁটির ওপর স্থাপন করা হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মধ্যে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান এবং ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পিলারের মধ্যে দ্বিতীয় স্প্যানটি বসানো হয়। ৩ মাসের ভেতরই রোববার (১১ মার্চ) ৩৯ ও ৪০ নম্বর পিলারের ওপর বসলো তৃতীয় স্প্যান। এমন ৪১টি স্প্যান জোড়া দিয়েই নির্মিত হবে পদ্মা সেতু। চতুর্থ স্প্যানটিও বসানোর মতো অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে। একটার পর একটা স্প্যান বসানোর ফলে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ মহাখুশি।
তারা বলছেন, জমাজমি হারিয়েও পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান দেখে তারা এখন অনেক আনন্দিত-উৎফুল্ল। দূর থেকে স্প্যান বসানোর দৃশ্য দেখে আনন্দে নেচে ওঠে নদীর পাড়ের মানুষ। স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখতে পেয়ে সবার চোখে মুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। পদ্মা সেতুর ৪৫০ মিটার দৃশ্যমান হওয়ায় এবং অগ্রগতির ধারাবাহিকতা দেখে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই সরকার ১০ জেলাকে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশের বৃহৎ সুপার স্ট্রাকচার পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে পাল্টে যাবে দৃশ্যপট। সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডের মতো আধুনিক শহর। ৩-৪ বছরের মধ্যে স্বপ্নের ছোঁয়ায় ভরে উঠবে অনুন্নত জনপদ। মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর হতে যাচ্ছে প্রথম ইনফরমেশন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, হাইটেক পার্ক, বেনারসি পল্লী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, দাদাভাই উপশহর। শিবচরের চরজানাজাত ইউনিয়নে হচ্ছে অলিম্পিক ভিলেজ। যেখানে থাকবে আন্তর্জাতিকমানের ৭টি স্টেডিয়াম, থাকছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সিটি, দেশের আরও এক মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠেছে জেলার চরজানাজাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে এ পদ্মা সেতুকে ঘিরে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228