ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সেই রাতে ঝড় ছিল

আহাদ আদনান
🕐 ২:৫৩ অপরাহ্ণ, মে ১১, ২০২১

সেই রাতে ঝড় ছিল

বৈশাখের রাতগুলোতে প্রায়ই চারদিক আঁধার করে ঝড় নামে। দরজা জানালা বন্ধ করে প্রমাদ গোনে এই শহরের লোকজন। একেকটা বজ্রপাতের শব্দে মনে হয় আকাশটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। রাস্তার কুকুরটা পর্যন্ত ঘাপটি মেরে থাকে বস্তির গলিতে। আর তখনই কিনা মেয়েটা একলা ছাদে চলে যায়। অন্ধকার ভেদ করে যখন বজ্রপাত হয়, আর সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এই শহর, শহরের ক্লান্ত, উচ্ছিষ্ট রাতের সড়ক, সেই সড়কে জমে ওঠা নোংরা কাদাজল, তখন আমরাও দেখতে পাই একজোড়া নয়ন। আহা, কী অপূর্ব সেই দুটি নয়ন। সেই নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির জল। বোকারা অশ্রু বলে ভুল করে। ফোলা ফোলা লাল চোখ যখন শূন্যের দিকে তাকিয়ে, বিকৃত মুখের অবয়বের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চিৎকার করে ওঠে সুমি, যেই চিৎকার শুনতে পায় না এই গ্রহের কোনো শ্রবণেন্দ্রিয়, ওপারে একজন ঠিকই জানেন এই কান্নার রহস্য।

গল্পের শুরু দশ বছর আগের এক বৈশাখে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। বায়না ধরে সুমি, গ্রামে যাবে। বৈশাখী মেলা দেখা হয় না অনেক বছর হয়ে গেছে। ঢাকার বৈশাখকে ঠিক বৈশাখ বৈশাখ মনে হয় না ওর। বান্ধবীরা মজা করে ওকে নিয়ে। ‘তুই একটা গেঁয়ো হয়েই থাকবি। তোর ফাস্টফুড ভালো লাগে না, হাইওয়েতে লংড্রাইভ ভালো লাগে না, ইংরেজি হিন্দি ছবি দেখিস না। কী সব কবিতা লিখিস। গ্রামের বিলে ডিঙি নৌকায় ভেসে বেড়াস, তোর জন্য কে বসে আছে খাল থেকে শাপলা ফুল তুলে দিতে। বড় হওয়ার পর গ্রামে কয়বার গিয়েছিস তুই? এসব কল্পনা কীভাবে মাথায় আসে তোর? আমাদের সবার বয়ফ্রেন্ড আছে। সিম আছে। বাবার ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কল করি। আর তুই? কিছুই নেই। তোর বিয়ে হবে গ্রামের লুঙ্গি পরা কোনো মাঝির সঙ্গে, মিলিয়ে নিস’।
আজ বাংলা নতুন বছর। ‘চাচা, সন্ধ্যার আগে চলে আসব’ বলে সুমি যখন চলে গেল, শহরের একটা মেয়ে, এই গ্রামের রাস্তাঘাট কিছু জানে না, সঙ্গে শুধু দুই চাচাত বোন, আর হাফপ্যান্ট পরা ভাই, উচিত ছিল সঙ্গে যাওয়া। দুপুর গড়াতেই আকাশ কালো করে আগাম জানান দেবে বৈশাখের ঝড়, চাচা কি আর জানবেন? ‘কি বিপদ, কও তো দেখি? সুমি মাইয়াটা কেমনে গেল মেলায়। এহন তো আন্ধার হইয়া আইল। কালবৈশাখী নামব নির্ঘাত’। মেলা বসে খালের ওপারের মাঠটায়। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে যেতে হয় ওপারে। মেয়েটা সাঁতার জানে কিনা তাও জানা নেই। বেরুব বেরুব করে, ছাতাটা খুঁজি খুঁজি করতে হঠাৎই শুরু হলো দমকা হাওয়া। অমাবস্যার রাত নেমে এলো পড়ন্ত দুপুরে। তাকানোর জো নেই, পাগলা হাওয়ায় ভাসছে বর্শা ফলা। মনির ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে না। পাশের চৌধুরীদের বাড়িতে জায়গির থাকে বোকা বোকা ছেলেটা। দরকারের সময় কাউকে পাওয়া যায় না।
কালো আকাশ দেখেই ফিরতে হবে বুঝতে পারে সুমি। খালের পারে আসতেই চারদিক ওলটপালট করে ঝড় নামবে, আর খালটা লাফাতে থাকবে, আর দেখবে একটাও ডিঙি নেই, কে জানত! ভয়ে যখন চিৎকারও বের হচ্ছে না গলা দিয়ে, আর আশপাশে দুই তিনটা অচেনা ছোকরা ছাড়া কেউ নেই, তখন ঝড়ের মাঝে অসহায় চারজন জড়াজড়ি করে কাঁপতে থাকে। এই ঝড় থামবে কখন? সারা রাত চলবে নাকি? ঝড়ে, বজ্রপাতে, ঠা-ায় বাঁচবে কেমন করে? কেয়ামত নেমে আসে ছোট্ট পৃথিবীটায়। ইসরাফিলের শিঙ্গায় সব তছনছ। তখন যেন মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসে ছেলেটা। মনির ভাই, পাশের বাসার জায়গির ছেলেটা যেন আশীর্বাদের মতো হাজির হয়। সহজ সরল, বোকামত ছেলেটা যে একটা ছাতা হয়ে আগলে রাখবে, সাহস দেবে, অভয় দেবে, উড়িয়ে দেবে পাথরের মতো বোঝা হয়ে লটকে থাকা ঘণ্টাখানেক সময়, মেয়েটা এখনো ভেবে পায় না কী করে সম্ভব! সন্ধ্যার আগেই ঝড় থেমে যায়। কিন্তু খাল পার হবে কীভাবে, ডিঙি যে নেই? ‘আমি সাঁতার জানি না, মনির ভাই’ বলে যখন ফ্যালফ্যাল করে থাকে সুমি। টুম্পাটা ফস করে বলে ফেলে, ‘তুমি কাঁধে চড়িয়ে পার করে দাও সুমি আপুকে, মনির ভাই’। ইচ্ছে করছিল একটা চড় লাগিয়ে দিতে গালে। আজ কেন যেন মনে হচ্ছে, ছেলেটার কাঁধে করে সেদিনের খালটার মতো সারাটা জীবন যদি পার করে দেওয়া যেত, মন্দ হতো না। একটা সুখস্বপ্নের মতো চট করে খালটা শেষ হয়ে গেল। বিপদের আরও বাকি। গ্রামের আম বাগানটা ঝড়ের পরে সন্ধ্যায় ঘন অরণ্য মনে হয়। নিকষ অন্ধকার সেই অরণ্যে। হাত দুটো তখন কাঁধ ছেড়ে হাতে। ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ভয় করে যে! সেই অরণ্যে যখন বজ্রপাতের আলো চমকে উঠে, আর এক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সেই কঠিন অথচ উষ্ণ হাতের সেই মানুষটি, ইচ্ছে করে, বজ্রপাতে বজ্রপাতে যদি কেটে যেত একটা সারা জীবন, আর সেই মানুষটি বুকে টেনে নিয়ে বলত, ভয় নেই, আমি আছি, তাহলে কেমন হতো?
ঘোরলাগা একটা নির্ঘুম রাত পেরিয়ে সুমি পরের দিনই চলে আসে শহরে। যাওয়ার সময় খুব ইচ্ছে করছিল মনিরকে দেখতে। শহরের গ্রীষ্মটা যেন অচেনা মনে হচ্ছিল। লাল নীল রেস্তোরাঁ, মল, ক্যাম্পাসে দামি ব্র্যান্ডে সেজে থাকা সুদর্শন যুবকের ভিড়ে সুমি খুঁজে ফেরে মনিরকে। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা গ্রামের ছেলে। ভোরে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা হাবাগোবা যুবক। ঝড়ের প্রহরে শক্ত হাত, দৃঢ় পেশি আর বিশাল বুকে আগলে রাখা পুরুষ। অনেক কষ্টে বর্ষা পড়তেই আবার গ্রামে আসে সুমি। প্রেমে পড়া মেয়েটা দেখে গ্রামে আর নেই মনির। কেউ জানে না, কোথায় চলে গেছে। চোখ ভেঙে কান্না পায় ওর। তবু শহরে ফিরতে হয়। মাঝে চলে যায় দশটা বছর। এই বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস-ও হয়ে গেছে। সবার হাতে হাতে এখন মুঠোফোন। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব নামের জাদুর পৃথিবী আসে। সেই পৃথিবীতে হাজার হাজার মনির। কিন্তু একটাও সেই ‘মনির’ নেই। একটা সময় দশ বছরের মনমরা মেয়েটার মুখে রঙ মেখে, লাল শাড়ি পরে, পুতুল সেজে বসে থাকে মঞ্চে। সেই পুতুলকে আমরা ‘নতুন বউ’ বলি। তার সঙ্গে ছবি তুলি, সেলফি তুলি। মেয়েটা মরার মতো চেয়ে থাকে। হঠাৎ দেখে একটা ছেলে, পেশাদার ছবিওয়ালা হবে হয়তো, লেন্স হাতে তুলে অবাক চেয়ে আছে। মনির ভাই! মেয়েটার মাথা ঘুরতে থাকে।

বাসর রাত। আর এমন কালবৈশাখী ঝড়! নতুন বর খুশিই মনে হয়। কিন্তু বউ তার ‘একটু আসি’ বলে কোথায় গেল? ছাদে নাকি? ছাদেই তো। পাগল নাকি! মেয়েটা এই ঝড়ে একা ভিজছে কেন? ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো! ঝড়, বজ্রপাত পেরিয়ে ডাক শুনতে পারছে না মেয়েটা।
এই ঝড় যদি না থামে, পৌনঃপুনিক বজ্রপাত নেমে আসে হৃদয়ে, একটা জীবন কী করে কাটাবে ‘বধির’ মেয়েটা!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper